গোলটেবিল
সরকারের এক বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
তীব্র জুলাই আন্দোলনের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ওইদিনই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা ভারতে পালিয়ে যান। দেশে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। ওই বছরের ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। আজ ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এবং আগামী ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। যে আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন নিয়ে জুলাই আন্দোলন শুরু এবং ওই আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষ হাতহত হয়েছেন, সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে অগ্রগতি, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দৈনিক যুগান্তর আয়োজন করে ‘সরকারের এক বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। যুগান্তর সম্পাদক কবি আবদুল হাই শিকদারের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির, বিএনপির চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, আমার বাংলাদেশ পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদিব, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদী এবং বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য মাহমুদা হাবিবা। উপস্থিত ছিলেন যুগান্তরের প্রধান বার্তা-সম্পাদক আবদুর রহমান, সিটি এডিটর মিজান মালিক, সম্পাদকীয় বিভাগের হাসান শরীফ, সাহিত্য সম্পাদক জুননু রাইন প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন যুগান্তরের প্রধান প্রতিবেদক মাসুদ করিম।
আবদুল আউয়াল মিন্টু
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই
বক্তব্যের শুরুতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এবং ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এবং আহতদের প্রতি সমবেদনা জানাই। আমরা দেশের সামাজিক শৃঙ্খলা চাই, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চাই, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চাই। কিন্তু বাংলাদেশে অর্থনৈতিক দিক থেকে কোনো প্রাপ্তি কি এখনো পূরণ হইছে? সামাজিক শৃঙ্খলা কি ফিরে এসেছে? বরং আরও খারাপের দিকে গেছে। অনেকে রিজার্ভ বাড়ার কথা বলেন। ডলার বিনিময় হার স্থিতিশীলতার কথা বলেন। কিন্তু এগুলো কোনো অর্থনৈতিক সুযোগের মধ্যে পড়ে না।
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, যদি এ মুহূর্তে দেশের পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে নির্বাচিত সরকার লাগবে। সেই নির্বাচিত সরকার হতে হবে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে। অনেকেই বলেন, শুধু একটি নির্বাচনের জন্য সংগ্রাম করেননি। তাদের উদ্দেশে আমি বলি, আপনাদের অনেক আগ থেকে আমরা আন্দোলন করছি। আমি তিনবার জেলে গিয়েছি। আমার নামে ৩৪টা মামলা রয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছি। আমি মনে করি, এখন আমরা নির্বাচন চাচ্ছি দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। সেই অধিকারের জন্য রাস্তায় নেমে যারা জুলাই-আগস্টে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, তাদের ধন্যবাদ জানাই।
তিনি বলেন, আসুন আমরা সবাই মিলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করি। মানুষের অধিকার, মানুষের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করি। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কার একদিনের কাজ নয়, এক জনমেরও নয়। সংস্কার চলবে। আমাদের নেতা তারেক রহমান ইতোমধ্যে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি মনে করি, তার যোগ্য নেতৃত্ব যদি নিতে পারেন, তাহলে অনেক সংস্কার হবে যেগুলো আমরা এখন চাচ্ছি। দ্রুত নির্বাচনের দাবি করে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, আমরা সমর্থন দিয়ে এ সরকারকে প্রতিষ্ঠা করেছি। অন্য সবার সঙ্গে আমরা এখনো সমর্থন করি। তবে আমরা এটাও চাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে এমন সরকার গঠন করা, যেই সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। যে দায়বদ্ধতা থেকে আমরা আমাদের আশা এবং প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করব।
অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
একটা ভবন তৈরি করতে গেলে শক্ত ফাউন্ডেশন লাগে। ফাউন্ডেশনটা যদি মজবুত না হয়, তার ওপরে বহুতল ভবন তৈরি করা যায় না। আমরা বহুতল ভবন তৈরি করতে চাচ্ছি, কিন্তু ফাউন্ডেশনটা বদলানো বা ফাউন্ডেশনকে মজবুতভাবে তৈরি করার চেষ্টা করছি না। সংবিধান পরিবর্তন সমাজের উপরি কাঠামোর ব্যাপার। কিন্তু মূল কাঠামো ইকোনমিক সিস্টেম। সেখানে যদি পরিবর্তন না হয়, যারা পুরোনো আমলে রাষ্ট্র দখল করেছিল, যাদের অলিগার্ক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের স্বপদে রেখে কোনো পরিবর্তন হবে না, কোনো গণতন্ত্র আসবে না। গণতন্ত্রের জন্য ভিত্তি তৈরি করতে হবে। সেই ভিত্তিটা স্বাস্থ্যকর পুঁজিবাদের মাধ্যমে হতে হবে। বলা হয়ে থাকে, বুর্জোয়া গোষ্ঠী না থাকলে দেশে গণতন্ত্র আসে না। উৎপাদনশীল, বিনিয়োগকারী, ঝুঁকি গ্রহণকারী এবং সৃজনশীল পুঁজিবাদী গোষ্ঠী-এরা যদি আসে তাহলে আমরা পরিবর্তনের আশা করতে পারি, গণতন্ত্রের আশা করতে পারি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছি না।
তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংস্কার হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচন হলে হয়তো অনেক কাজকর্ম করা যাবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আমলাতন্ত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি, পুলিশবাহিনীতে কোনো পরিবর্তন আসেনি, অনেক জায়গায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। এ পরিবর্তন ছাড়া খুব একটা এগোনো যাবে না। নির্বাচিত সরকারও কতদূর সেটা পারবে, এ নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। কারণ, গত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সেই কাঠামো তৈরি করে গেছে, তা উচ্ছেদ করা এবং সেখানে একটা নতুন কিছু দিয়ে পুনঃস্থাপন করা মোটেও সহজ কাজ না।
আক্ষেপ প্রকাশ করে মাহবুব উল্লাহ বলেন, নির্বাচন হলে এ দেশের নদীতে কি মধু কিংবা দুধ প্রবাহিত হবে-এমনটাও আশা করা উচিত না। কারণ, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয় না। মৌলিক পরিবর্তন কিন্তু বিপ্লবেই হয়। কিন্তু সেই বিপ্লব করার যোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্য রাজনৈতিক দল, যোগ্য সংগঠন দরকার-যেটা আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। তিনি আরও বলেন, সরকারের কাছে বাংলাদেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশা। এ ধরনের প্রত্যাশা মার্কিন বা ব্রিটিশ নাগরিকের মধ্যে থাকে না। কারণ, আমাদের যাপিত জীবনে এত অনাহার, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, অশিক্ষা, কুসংস্কার রয়েছে, সেখানে প্রত্যাশা উঁচু হওয়া স্বাভাবিক। পরিবর্তনের এত আকাঙ্ক্ষা, রক্তদান, আত্মাহুতি, ত্যাগ ও সাহসিকতার পরও যে প্রত্যাশা, সেটা পূরণ করতে পারছি না।
অধ্যাপক আবু আহমেদ
চেয়ারম্যান, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)
ফ্যাসিস্ট হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকতে আমলা, পুলিশ, শিক্ষক, ব্যবসায়ী-সবখানেই মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেছিল। এ সরকারের ব্যর্থতা থাকলে সামগ্রিকভাবে সেটা সবার ব্যর্থতা। তাই যতক্ষণ এ সরকার ক্ষমতায় আছে, সবার উচিত তাদের সহায়তা করা। তিনি বলেন, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা শেখ হাসিনা স্বৈরাচারের পতন কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। আমাদের মতো বুড়োরা তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। গত ১৫ বছর বিএনপি আন্দোলন করেছে, তাদের বিপুল সংখ্যক কর্মী ঘরছাড়া হয়েছে। তাদের আন্দোলন দমন করা হয়েছে। কিন্তু যখন ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নামল, তাদের সঙ্গে জনতা নামল, রাজনৈতিক দলগুলো নামল; তখন সাফল্য এসেছে। তাই ছাত্রদের এই সুপ্রিম সেক্রিফাইসকে স্বীকৃতি দিতে হবে, এটা হারিয়ে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না।
তিনি আরও বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশের কারণে বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, ফ্যাসিস্ট জন্ম নিয়েছে। একটা নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে তাকে কখনোই পালিয়ে যেতে হতো না। এ দেশেই থাকতে পারত। একজন প্রধান বিচারপতি এখন জেলে আছে, এ নিয়ে অনেকে আফসোস করেন। কিন্তু তিনি বড় অপরাধী। বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছেন তিনি। পার্শ্ববর্তী দেশের কারণে বাংলাদেশে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে ওঠেনি। পক্ষান্তরে তাদের সুবিধার জন্য ফেনী নদীর ওপর ব্রিজ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি করেছে, সেখান থেকে আমরা কী পেয়েছি? আদানির বিদ্যুৎ চুক্তির এক্সিট ক্লজ রাখা হয়নি। এ কারণে ৭০০ মিলিয়ন ডলার দিতে হয়েছে।
আবু আহমেদ বলেন, অনেকে বাহাত্তরের সংবিধান সংশোধনের সমালোচনা করেন। কিন্তু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা নিজেই কতবার সংবিধান কাটাছেঁড়া করেছেন, তখন তো কেউ কিছু বলেননি। জুলাই সনদ সংবিধানের অংশ না হলে এর কোনো মূল্য থাকবে না।
মাহমুদুর রহমান মান্না
সভাপতি, নাগরিক ঐক্য
যারা গণ-অভ্যুত্থানে আন্দোলন করেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো ১৫ বছর ধরে আন্দোলন করেছে-সবারই একটা চাওয়া ছিল-ফ্যাসিবাদের পতন। সেই ফ্যাসিবাদের পতনের পর একটা অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে। গত তিনটি নির্বাচন যেভাবে হয়েছে, এ সরকারের কাছে সেইরকম একটা নির্বাচন আমরা চাই না। আমরা চাই, সরকার সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা কোয়ালিটিফুল নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। এর জন্য যা যা সংস্কার করার, তা করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা কিন্তু পুলিশকে বলেননি, তোমাদের ওপর যা হয়েছে, তোমাদের কৃতকর্মের কারণেই হয়েছে। যারা অন্যায় করেছ, তাদের বিচার করব। কিন্তু বাকিদের আমি সিকিউরিটি দিচ্ছি, কিছু হবে না। কিন্তু তোমাদের দায়িত্ব এ নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে যোগ দিতে হবে। পুলিশকে রিঅর্গানাইজড করার জন্য যে কাজগুলো করা দরকার, সেগুলো করেননি। অতএব পুলিশ কী করবে জানি না। এখন আমরাই আমাদের রক্ষক। আমরাই প্রতিদ্বন্দ্বী এবং আমরাই এটার মূল খেলোয়াড়। যদি মনে করেন, এই অন্তর্বর্তী সরকার করে দেবে, এই এক বছরে তারা কিছু করতে পারেনি। আগামী ছয় মাসের মধ্যে করতে পারবেন, সেটাও বলতে পারছি না। আবার যদি হঠাৎ করে বলে ফেলেন যে, এই না হলে নির্বাচন করব না। তখন সামাল দিতে পারবেন না।
প্রধান উপদেষ্টা সংস্কারের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তা ইউনিক। তবে এটাও সত্য, এখন পর্যন্ত তিনি একটিও সংস্কার শেষ করতে পারেননি। কীভাবে সংস্কার করবেন? সংবিধান সংস্কার করতে হলে সংসদে পাশ করতে হবে। নির্বাচনে বেশি আসনে যারা জিততে পারে, তারা এর বিরোধিতা করছে। ১৯টি মৌলিক বিষয়ের মধ্যে তারা ১০টিই মানে না। এখন আপাতত একসঙ্গে চলছি, সেজন্য তারা রাজি হচ্ছে আর বলছে সামনে এগিয়ে চলেন। কিন্তু নির্বাচনের পর যখন সংসদ বসবে, তখন এসব সংস্কারের কী হবে? আমরা কি কেউ বিএনপিকে জিজ্ঞেস করেছি যে, আপনারা সংস্কারের যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন, ক্ষমতায় যাওয়ার পর কি সেগুলো ইয়েস বলবেন নাকি নো বলবেন?
এম হুমায়ুন কবির
সাবেক রাষ্ট্রদূত
একটা সরকার (আওয়ামী লীগ) ১৫-১৬ বছর ক্ষমতায় ছিল। তাদের একটা কাঠামো কিন্তু বাইরে তৈরি হয়েছিল। কাজেই সেই কাঠামোর বিপরীতে গিয়ে মানুষের প্রত্যাশার কাঠামোকে তৈরি করা বা স্থাপন করা এই নতুন চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমি নির্দ্বিধায় সরকারকে বিশেষ করে সরকারপ্রধান অধ্যাপক ইউনূসকে কৃতিত্ব দেব। তার উপস্থিতি আমাদের দুটি অনিশ্চয়তা কাটাতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা ঘটেছিল। জাতিসংঘ ওইসব ঘটনায় যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই এ কাজে যারা যুক্ত ছিল, তাদের বিচার পরিচালনা করা যাবে। সেটা তারাও বলেছে ওই রিপোর্টে। আমি মনে করি, এটি একটি আইনি ভিত্তি হিসাবে থাকবে। এটির একটি অসাধারণ গুরুত্ব এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।
কয়েকটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সামনে আছে। এ সরকার এবং ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে, তাদের জন্য ওই চ্যালেঞ্জ থাকবে। প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে-আমরা যে সংস্কার কার্যক্রম করছি, সেটা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সাংবিধানিক সংস্কার বলেন, এই সংস্কারগুলোর আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রয়োজন হবে। এটা শুধু আমাদের আয়োজন দিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারব না। এগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমাদের বন্ধু, অংশীদার, যারা আছে তাদের পুরোপুরি সমর্থন বা পূর্ণ সমর্থন আমাদের প্রয়োজন। যে সরকারে আসবে, ভবিষ্যতে তাদের সেই কার্যক্রমটা সৃজনশীলভাবে চালিয়ে যেতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন-ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিনি, চীনারা কী বলছে। তাদের কথার ইঙ্গিতগুলো যদি বোঝেন, তাহলে বুঝতে পারবেন তাদের একটা প্রত্যাশা আছে। তারা এ দেশে সুশাসন চায়। মানবিক সমাজ চায়। একটা দায়বদ্ধ শাসন কাঠামো চায়। গণতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থা চায়। কারণ, তাদের সবার এখানে স্বার্থ আছে। সেই স্বার্থটা নিশ্চিত করার জন্য বা সুনিশ্চিত করার জন্য তারা একটা স্থিতিশীল বাংলাদেশ চায়। কাজেই স্থিতিশীল বাংলাদেশ আসতে গেলে আপনাকে এই চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাদেরও যুক্ত করতে হবে। তবেই কিন্তু এই তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষের প্রত্যাশা প্রতিফলন করে যে পরিবর্তনটা এনেছে, সেই পরিবর্তনকে আমরা টেকসই করতে পারব।
মাহমুদ হাসান খান
সভাপতি, বিজিএমইএ
গত এক বছরে ‘লুটেরা’, ‘রক্তচোষা’ হিসাবে ব্যবসায়ীদের যেভাবে ট্যাগ দেওয়া হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে কেউ ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হতে চাইবে না বলে মনে করেন বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান। তিনি বলেন, দু-একজন, সর্বোচ্চ ৫ জন ব্যবসায়ীর কারণে পুরো ব্যবসায়ী সমাজকে দুর্নীতিবাজের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কেউ উদ্যোক্তা হতে চাইবে না। কারণ, বর্তমান প্রজন্মের কাছে অনেক অপশন আছে। আর একজন উদ্যোক্তা নিজে নিজে কখনোই রক্তচোষা হয়ে উঠতে পারে না। রাজনীতি ও রাজনীতিকরাই এস. আলম ও সালমান এফ রহমান তৈরি করেছে। সরকার যদি না চাইত তাহলে কখনোই দরবেশ-১ বা দরবেশ-২ এর সৃষ্টি হতো না।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, গত এক বছরে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য দেখছি। এখন এটা কি প্রত্যাশার সমস্যা, নাকি প্রাপ্তির সমস্যা-সেটা আলোচনার বিষয়। এই সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক ছিল, এ প্রত্যাশাটা বাড়ল কেন? সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই অনেক সংস্কার কমিশন করেছে। আমরা আশা করেছিলাম, এবার বুঝি প্রয়োজনীয় সংস্কার হবে। কিন্তু কোনো রিফর্মই আলোর মুখে দেখছে না। জ্বালানি সমস্যার এখনো সমাধান হয়নি। বরং আমরা দেখলাম, একটি বিদেশি সোলার পাওয়ার প্ল্যান্টের অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে। এটা কি বিশ্বে ভালো বার্তা দিল। এ কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে ইতস্ততবোধ করবে। তাদের কাছে বার্তা গেল, সরকারের করা চুক্তিও টেকসই হয় না।
এ সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় পজিটিভ দিক হলো-লুটপাট বন্ধ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং সেক্টরে একটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। তৃতীয়ত, রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি। চতুর্থ, মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে। পঞ্চম, অর্থনীতির ভুয়া পরিসংখ্যান দেয়নি। বিগত সরকারের আমলের সেই চর্চা করা হচ্ছে না। এগুলো হলো সরকারের ইতিবাচক সাফল্য।
মাহমুদ হাসান খান বলেন, গত এক বছরে বিনিয়োগ হয়নি। বিনিয়োগ হওয়ারও বাস্তবসম্মত কারণও দেখছি না। লুটপাটের হিসাব গোপন করায় এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অবশ্য খেলাপি ঋণ আগেই ছিল। সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক সংখ্যার মারপ্যাঁচে লুকিয়ে ছিল। এই খেলাপি ঋণের কারণে সুদহার ১৪-১৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই সুদ দিয়ে শিল্প স্থাপন সম্ভব নয়, যদি না সে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত দেওয়ার চিন্তা না করে। অবশ্য আশার কথা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। এ কারণে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে বা কমপক্ষে ১০ শতাংশ নামলে বিনিয়োগ হবে।
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ
সাধারণ সম্পাদক, আমার বাংলাদেশ পার্টি
দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দিকে তাকালে দেখা যায়, যেসব দেশে অভ্যুত্থানের পর যে ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, বাংলাদেশে ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর সেই উপকরণগুলো বিরাজ করছিল। এদেশে গৃহযুদ্ধ, অস্ত্রধারী গ্রুপগুলোর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও দুর্ভিক্ষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের তার কিছুই হয়নি। বরং দেশে স্থিতিশীলতা রয়েছে। দ্রব্যমূল্য নাগালের মধ্যে রয়েছে। তবুও কিছু তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বক্তব্য দেন যে, তারা নাকি গত ৪০ বছরেও এমন পরিস্থিতি দেখেননি। আমি বলতে চাই, ওইসব সুশীলেরা কলকাতা এবং দিল্লির চোখ ছাড়া নিজেদের চোখে দেখতে পায় না। তারা শুধু চিন্তা করে আহারে আগেই তো ভালো ছিলাম। ওই সুশীলরা অন্তর্বর্তী সরকারকে হেয় করে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। ওই সুশীলরা বাংলাদেশকে ধারণ করে না। দেশকে এগিয়ে নিতে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। প্রত্যাশা-প্রাপ্তির জায়গায় যেন এটা না হয় যে, অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখতে সমালোচনা তৈরির সুযোগ করে না দিই। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ইন্টারি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে সমালোচনা করার একটা এক্সকিউজ যেন তৈরি না হয়। নির্বাচনের এখন ছয় মাস বা আট মাস বাকি আছে, এই সময়ে ভালো কিছু করার জন্য সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারি।
মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর
বিএনপির চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা
অনেকে দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলছেন। কথাটা আংশিক সত্য, আংশিক হয়তো সত্য নয়। কিন্তু এই নিরাপত্তাঝুঁকিটার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। কারণ, আমরা শত্রু চিনতে ভুল করি। শত্রু যে কেবল ওপারেই থাকে তা নয়। শত্রু আমাদের মধ্যেও বিরাজমান আছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই, বলতে গেলে স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের দেশের ইসলামিক কালচারটাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এমন কোনো চেষ্টা নেই যা পার্শ্ববর্তী দেশ করেনি। আমরা বুঝে-শুনে সেটা নীরবে মেনে নিয়েছি। মেনে নেওয়ায় আজ এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছি, আমি শত্রু নাকি আপনি শত্রু-এই বোধশক্তিটাও হারিয়ে ফেলছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা যদি দেশকে সত্যি সত্যি ভালোবাসি, এ দেশকে সুরক্ষা দিতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমরা বিশ্বমঞ্চে নিজেদের মাথা উঁচু করে যে দাঁড়াব, সেই দিকে আমরা কর্ণপাত করি না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এটা সত্য, আমাদের দেশটা ছোট। আয় উপার্জনের ক্ষমতা আমাদের খুব সীমিত। সাধারণভাবেই আমরা দেখেছি, যখনই দেশে আমরা নিরাপত্তাহীনতা ভুগি, তখনই কিন্তু জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। আবার যখন স্থিতিশীলতা আসে তখন কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে বেঁচে থাকার চিন্তা করি। যারা আমাদের একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চায় না, তারাই এ সুযোগটা নেয়। এ সুযোগ যাতে আর নিতে না পারে, সেজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
সামান্তা শারমিন
সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, এনসিপি
আগস্টে ফ্যাস্টিস্ট হাসিনা পালিয়ে গেছে। কিন্তু এখন কি আমরা মন খুলে কথা বলতে পারছি। ভয়-শঙ্কাহীন সমাজ কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? না, হয়নি। ফলে আমাদের এ দুর্ভাগা জাতিকে আরও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
ঠিক এক বছর আগে এই আগস্টে দেশে কি হচ্ছিল, তা একবার আমরা স্মরণ করে দেখতে পারি। এই যে এত মানুষ জীবন দিয়েছেন, তাদের দেহ যদি এই কক্ষে রাখা হয়, তাহলে লাশের স্তূপ এখানে ধরবে না হয়তো। ৫শ মানুষের হারানো চোখ যদি একটা পাত্রে রাখেন, সেই পাত্রটা কত বড় হবে-এগুলো একসঙ্গে আমাদের আরেকবার দেখা দরকার। তাহলে আপনি আপনার কর্তব্যটা মনে করতে পারবেন। আমরা কি শুধু একটা সংসদীয় নির্বাচনের জন্য এতগুলো প্রাণ দিলাম? এতগুলো চোখ, হাত-পা অসংখ্য অঙ্গহানি হলো? সেটা আমাদের ভেবে দেখা দরকার।
এসব মাথায় রেখেই আমরা দল করেছি। কিন্তু হতাশ হতে হয় যখন দেখি প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকারে একজন উপদেষ্টারও বডি ল্যাঙ্গুয়েজে এটা নেই যে কতজনের লাশের ওপর দিয়ে এই সরকারটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একজনের খুলি উড়ে গিয়ে তার মাথার মগজ পড়েছে আরেকজন সহযোদ্ধার ওপর। এই দৃশ্যপটের পর বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সচিবগুলো সব আগের। অথচ তারা বলছে, তারা নাকি বৈষম্যের শিকার। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বিশেষ করে পররাষ্ট্র, অর্থ, শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেসব সচিব আছেন, তারা কার সুপারিশে এসেছেন, তা উন্মুক্ত করা হোক।
আরিফুল ইসলাম আদিব
সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক এনসিপি
অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিবাদের দোসরদের একটি ছোট অংশ হয়তো পালিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের ৭০ শতাংশ এখনো বহাল। ফলে আগের সেই পুরোনো কাঠামো টিকিয়ে রেখে পরিবর্তন প্রত্যাশা করলে আশাতীত ফল পাওয়া সম্ভব নয়। উদাহরণ হিসেবে, এই ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর এবং রাজশাহীসহ আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় বিবেচনায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে ফ্যাসিবাদের সময় গুম খুনের মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সিভিল সোসাইটি থেকে এর কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি। তিনি বলেন, গণমাধ্যমে উঠে এসেছে আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১ লাখ ২০ হাজার সদস্য প্রয়োজন। সেখানে বর্তমানে ১ লাখ ৯০ হাজার সদস্য রয়েছেন। অর্থাৎ এই ৭০ হাজারসহ বিগত সরকার মোট ১ লাখ ২০ হাজার পুলিশ নিয়োগ দিয়েছে। ফলে তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে এক অভিনব পরিস্থিতি দেখা গেছে। এ সময় সবচেয়ে জরুরি ছিল রাজনৈতিক বোঝাপড়া। তখন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে একটি জাতীয় সরকারের প্রস্তাবনাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা দেখা যায়নি। ঐকমত্য কমিশনেও একই অবস্থা। গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলোর ক্ষেত্রে তারা এক ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে রেখেছে। এভাবে জাতিকে একটা ভুল বোঝানো হচ্ছে।
মাহমুদা হাবিবা
সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল
গণ-অভ্যুত্থানপরবর্র্তী এ সময়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সরকারের সম্মানিক একজন উপদেষ্টাকে নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লাইক বা কমেন্ট করায় চাকরিচ্যুতি বা সাসপেন্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ সরকারের সময়ে এই ধরনের আচরণ কি আশা করা যায়? শেখ হাসিনা পালিয়ে চলে গেছে। তার ফ্যাসিবাদ আচরণ যদি নতুন সরকারের একটি অংশে দেখতে পাই, তাহলে দেশে কী পরিবর্তন হলো। আমাদের জোরের সঙ্গে বলতে হবে, কিছু কিছু বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি যে, কোনো মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতে দেব না, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হতে দেব না। জনসংখ্যার অর্ধেক নারীর এ দেশে যখন দেখি প্রকাশ্যে একজন নারীকে লাথি মারা হয়; যে লাথি মারল তাকে আবার ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। ভার্চুয়াল ও বাস্তব জগতে নারীরা কতটুকু নিরাপদ? সুনির্দিষ্ট মহলের পছন্দের না হলেই অশ্লীল, অশ্রাব্য, অপাঠযোগ্য শব্দ ব্যবহার করা হয়। এসব বন্ধ করতে হবে। নারীদের পিছিয়ে রেখে দেশ এগিয়ে যেতে পারে না।
শরিফ উসমান হাদী
মুখপাত্র, ইনকিলাব মঞ্চ
অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এলেও তারা দুর্বল। সরকার এখনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটন করতে পারেনি। কিছু সুশীল সমাজের প্রতিনিধির সাম্প্রতিক বক্তব্যের নিন্দা জানাই। এখন যতটা হতাশ, তারা গত ৪০ বছরেও এত হতাশ হয়নি। যারা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পরও কিছুই পরিবর্তন হয়নি, তাদের উদ্দেশে প্রশ্ন-গত এক বছরে রাষ্ট্রীয় মদদে কয়জন মানুষ গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। বিপ্লবের প্রথম শর্ত হলো ফ্যাসিবাদের সব চিহ্ন ভেঙে দিতে হবে। আমরা সেটা পারিনি। অন্তর্বর্তী সরকারের কতজন উপদেষ্টার সন্তান জুলাই আন্দোলনে মাঠে ছিল? কতজনের সন্তান আন্দোলনে নিহত বা আহত হয়েছেন? তারা কীভাবে এই বিপ্লবের মর্ম বুঝবেন? কীভাবে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে দেশের পরিবর্তন আনবেন। জুলাই অভ্যুত্থান তারাই বুঝবে, যারা নির্যাতিত হয়েছে।
আবদুল হাই শিকদার
সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর
যুগান্তর আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনার শুরুতে অংশ নেওয়া অতিথিদের স্বাগত জানাই। সবাইকে মুক্ত আলোচনার আহ্বান জানাই। বিপ্লব কোনো ডিনার পার্টি না। বিপ্লব হলো একটা বিরাজমান সমাজ কাঠামোকে উৎখাত করে, উৎপাটন করে নতুন একটা সমাজ নির্মাণ করার প্রচেষ্টা বা প্রয়াস বা স্বপ্ন। সেখানে বলপ্রয়োগ খুব জরুরি ব্যাপার। জুলাই জাগরণে আমরা দেখলাম, জনমানুষের ঢল রাস্তায় নামানোর মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী নিকৃষ্ট একটা শাসনগোষ্ঠীকে আমরা উৎখাত করেছি। কিন্তু পরবর্তী যে ধাপটা, নতুন সমাজ বিনির্মাণের যে কাজটা, সেইটা আমরা কতদূর করতে পারলাম? সমাপনী বক্তব্যে কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, জুলাই বিপ্লবের রক্তে রাঙানো পথে এই সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। তাদের সক্ষমতার চেয়ে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। এ কারণে মানুষের আশাভঙ্গ হচ্ছে। এছাড়া এই সরকারের উপদেষ্টারা অনেক অপ্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডেও নিজেদের যুক্ত করে প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়েছেন। এখন নিজেরাও চলতে পারেন না, দেশও চালাতে পারছেন না। এরকম একটি সমস্যায় আমরা বসে আছি। পতিত ফ্যাসিবাদ যারা আমাদের সন্তানদের হত্যা করেছে, যারা অসংখ্য মানুষের অঙ্গহানি করেছে, যারা গত ১৫ বছর জগদ্দল পাথরের মতো জাতির ঘাড়ে বসেছিল, সেই তারা এখন গেরিলা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ঢাকাতেই যদি সাত দিন ধরে ৪০০ লোক প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে, তাহলে অন্য জেলাগুলোর কী অবস্থা? এই যখন অবস্থা তখন গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সম্পত্তির ভাগাভাগি করছে। তিনি বলেন, এসব চক্রান্তের বিরুদ্ধে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে কাজ করতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানে যারা নিহত ও আহত হয়েছেন, তাদের অবদান সরকার, রাজনৈতিক দল ও অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলো কখনো যেন ভুলে না যায়, সেই আহ্বান জানাই।
