শিবালয়ের চরাঞ্চল
নদীভাঙনে অসহায় ৮ হাজার মানুষ
চরের জীবন
মো. নুরুজ্জামান, মানিকগঞ্জ
প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যমুনার ভাঙাগড়ার খেলার মাঝেই দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে জীবন পার করছেন মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার চরাঞ্চলের হাজারো মানুষ। প্রতিবছর নদীভাঙনে বাপ-দাদার বসতভিটা আর ফসলি জমি হারিয়ে অনেকেই এখন নিঃস্ব। বেঁচে থাকার শেষ সম্বল হারিয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত তিনটি ওয়ার্ডের প্রায় ৮ হাজার মানুষ। ভিটামাটি হারিয়ে ২ হাজার মানুষ অন্য জায়গায় বাড়ি করেছেন। সরকারি দপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন কোনোভাবে সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ ভাঙনকবলিত মানুষের।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, যমুনার চরাঞ্চলে অবস্থিত শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের মানুষ সবচেয়ে বেশি নদীভাঙনের শিকার। প্রতিবছর এই তিন ওয়ার্ডের মানুষ ভিটেমাটি হারাচ্ছে। অনেকের বাড়ি ৪ থেকে পাঁচবার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার সম্বল কৃষিজমিও কেড়ে নিয়েছে যমুনা। নদীভাঙনে নিঃস্ব মানুষগুলো ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারছে না। এ কারণে বাবা-মা অপ্রাপ্তবয়সের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। এতে গর্ভবতী মায়ের পাশাপাশি নবজাতকেরও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। এই চরাঞ্চলের ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নেই চিকিৎসাব্যবস্থা। পুষ্টিহীনতায় ভুগছে শিশুরা। অধিবাসীদের অভিযোগ, নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও নির্বাচিত হয়ে এমপি, মন্ত্রী বা চেয়ারম্যান-মেম্বার কেউ তাদের খোঁজ রাখেন না।
তেওতা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ত্রিশুণ্ডী গ্রামের কামরুজ্জামান (৪০) বলেন, আমার এই বয়সে চারবার বাড়ি ভেঙেছে। যমুনার সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলছি প্রতিনিয়তই। কৃষিকাজ আমাদের রোজগারের একমাত্র পথ। নদী আমাদের সব জমি কেড়ে নিয়েছে। ঘরে ৪টি মেয়ে রয়েছে। অভাবের সংসারে তেমন লেখাপড়া করাতে পারিনি। মাঝেমধ্যে সরকারি লোক এসে নাম লিখে নিয়ে যায়। কিন্তু কোনো সহযোগিতা পাইনি।
রঘুনাথ গ্রামের মাসুদ রানা ৩৫ বছরের জীবনে পাঁচবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছেন। নদী কেড়ে নিয়েছে ভিটামাটিসহ কৃষিজমি। এখন তিনি নিঃস্ব। সরকারের কোনো অনুদান পাননি। মাসুদ রানা যুগান্তরকে বলেন, আমরা চরের মানুষ প্রতিমুহূর্ত যমুনার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকি। রাতে ঘুমাই, সকালে দেখি ঘরবাড়ি নদীগর্ভে। সরকার যদি আমাদের গ্রাম রক্ষায় চেষ্টা করত, তাহলে হয়তো ভিটামাটি হারাতে হতো না। আমাদের শুধু নির্বাচনের সময় কদর বাড়ে। নির্বাচনের পর কোনো এমপি আর আমাদের চরে আসেন না।
শিবালয় উপজেলা বিএনপি নেতা এসএম আব্বাস বলেন, তেওতা ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ডের জনগণ সব সময় অবহেলিত। তাদের নেই কোনো চিকিৎসাব্যবস্থা; নেই কোনো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীরা এই চরের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছলনা করেছে। কোটি কোটি টাকার প্রকল্প এনে বাস্তবায়ন না করে নিজেদের পকেট ভারী করে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যবদলে বিএনপি সব সময় পাশে ছিল, আগামী দিনেও থাকবে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. লুৎফর রহমান বলেন, এ বছর নদীভাঙনকবলিত ২২৫০ জন মানুষের মধ্যে ৩০ কেজি করে চাল ও শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। শিবালয়ের তেওতা চরের ২৫ জনকে শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। উপজেলা থেকে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে দেওয়া হলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, দেশের জনগণ হিসাবে সবাই নাগরিক সুবিধা পাবে, এটাই নিয়ম। চরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে চাল দেওয়া হচ্ছে। সরকারের অন্যান্য সুবিধাও তাদের দেওয়া হচ্ছে। ভাঙন রোধে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
