ভাটি বাংলার আত্মা ফকির দুর্বিন শাহ
আনোয়ার হোসেন রনি, ছাতক (সুনামগঞ্জ)
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভাটি বাংলার বাউলসাধক ফকির দুর্বিন শাহ। তিনি কেবল একজন গীতিকারই নন, ছিলেন মালজোড়া গানের জনক, সুফি সাধক, দার্শনিক ও মানুষের নৈতিক জাগরণের পথপ্রদর্শক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সীমিত হলেও প্রজ্ঞায় তিনি ছিলেন অসাধারণ। তার গানে যেমন ভাটি অঞ্চলের মানুষের প্রেম-বিরহ, জনজীবন ও সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে, তেমনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে মানবতা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা ও আল্লাহ প্রেম। ভক্তদের কাছে তিনি ‘ভাটি বাংলার আত্মা’। প্রায় এক হাজার গান রচনা করা এই মরমি সাধকের সুর মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিকামী জনতাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত হলেও তিনি আজও পাননি কোনো বড় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
ফকির দুর্বিন শাহ ১৯২১ সালের ২ নভেম্বর সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার নোয়ারাই গ্রামের তারামনি টিলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সুফি সাধক সফাত আলী শাহ ও মা হাসিনা বানুর ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক পরিবেশ তাকে কৈশোর থেকেই গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই গ্রামের আখড়ায় গান গেয়ে খ্যাতি অর্জন করেন।
দুর্বিন শাহের সংগীতচর্চা ছিল এক অনন্য মিশ্রণ। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-মারিয়া ভুজঙ্গ তীর কলিজা করিল চৌচির, নামাজ আমার হইল না আদায়, আমি জন্মে জন্মে অপরাধী তোমারই চরণে রে, সুখের নিশি প্রভাত হলো, ছাড়িয়া যাইও না বন্ধু রে, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি ইত্যাদি। এই গানগুলো কেবল সুর নয়, বরং মানুষের অন্তরের বেদনা, প্রেম ও আলোর বার্তাও বয়ে আনে।
মালজোড়া গানকে তিনি কেবল সংগীত হিসাবে ব্যবহার করেননি; এটি হয়ে উঠেছিল মানুষের নৈতিক জাগরণের, আল্লাহ প্রেমের ও সত্য অনুসন্ধানের মাধ্যম। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করেছিলেন, যার মধ্যে চার শতাধিক গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা হলো-‘প্রেমসাগর পল্লীগীতি’ (পাঁচ খণ্ড), ‘পাক বঙ্গ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ গীতি’ ও ‘দুর্বিন শাহ সমগ্র’। তার গান সহজবোধ্য ও হৃদয়গ্রাহী হওয়ায় সাধারণ মানুষ সহজেই তা বুঝতে পারতেন এবং দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠত। দুর্বিন শাহের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও ছিল। ১৯৬৭ সালে কিংবদন্তি শিল্পী শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে লন্ডনে গান পরিবেশন করেন তিনি। সেখানে দুর্বিন শাহ ‘জ্ঞানের সাগর’ উপাধি পান। এছাড়াও ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-তে তার গান ব্যবহার করা হয়। এসব কৃতিত্ব তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯৭৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দুর্বিন শাহ মারা যান। মৃত্যুর প্রায় পাঁচ দশক পরও তার গান ভক্তদের হৃদয়ে সমানভাবে বেঁচে আছে। ছাতকের ‘দুর্বিন টিলা’য় প্রতিবছর অসংখ্য ভক্ত ও সাধক তার স্মরণে সমবেত হন। গান গেয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানান। ভক্তরা জানান, দুর্বিন শাহ কেবল একজন লোকশিল্পী বা গীতিকার নন, তিনি ভাটি বাংলার আত্মা। তার গানকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং তাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আজ সময়ের দাবি।
