প্রস্তাব অনুমোদন অর্থ উপদেষ্টার
নতুন মিশন হচ্ছে ডাব্লিন বুয়েন্স ও মিশিগানে
ভূরাজনৈতিক পরিবেশ, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং এলডিসি উত্তরণ মোকাবিলায় এ সিদ্ধান্ত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ তিন দেশে নতুন মিশন (কনস্যুলেট জেনারেল অফিস) খোলা হচ্ছে। অন্য মিশনগুলো হচ্ছে আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাব্লিন এবং আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স এইরেস। যুক্তরাষ্ট্রে একটি দূতাবাসসহ বর্তমানে চারটি মিশন কাজ করছে। এরপরও মিশিগানের ডেট্রয়েট শহরে নতুন মিশনটি চালু করা হবে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
ক্রমপরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক পরিবেশ, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রেক্ষাপট সামনে দাঁড়িয়েছে। ফলে ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ জোরদার, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে নতুন মিশন স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি মিশন খোলার বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন। সেখানে ৬টি মিশন খোলার সিদ্ধান্ত হয়। সেগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান, আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাব্লিন, আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স এইরেস, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট শহর, নরওয়ের অসলো এবং ব্রাজিলের সাওপাওলো। পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চারটি মিশন খোলার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেখানে বাদ দেওয়া হয় নরওয়ের অসলো এবং ব্রাজিলের সাওপাওলোর মিশন। এরপর আরও একটি বাদ দেওয়া হয়।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, মিশন খোলার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবগুলো নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে। কারণ, একটি মিশন চালুর সঙ্গে বছরে ২০ কোটি টাকা ব্যয় জড়িত। মিশনের লোকবল, পরিবহণ, বেতনভাতা ও বাড়ি ভাড়া-সবই ডলারে পরিশোধ করতে হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। সরকার নানাভাবে ব্যয় কমাচ্ছে। এসব দিক বিবেচনা করে তিনটি মিশন চালুর প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা।
এদিকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি ব্রিফিংয়ে বলেছেন, সরকার বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোয় জনবল বাড়ানোর কাজ করছে। মিশনগুলোকে প্রবাসীদের শতভাগ সমস্যার সমাধান করতে হবে। উপদেষ্টা আরও বলেন, সীমিত জনবল ও লজিস্টিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ মিশনগুলো বিশ্বব্যাপী এক কোটির বেশি প্রবাসীকে পরিষেবা দিচ্ছে। এখন নতুন যৌক্তিকতা থাকলে সেখানে নতুন মিশন খোলা হবে।
এদিকে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। ইতোমধ্যে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশে ২০ শতাংশ শুল্কের নতুন হার ঘোষণা করা হয়েছে বাংলাদেশের ওপর। শুল্ক কমানোর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শর্ত দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাদের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে সেনসাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করেছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। এ হিসাবে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ৬১৫ কোটি ডলারের। এ বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে নতুন মিশন চালু একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রে একটি দূতাবাসসহ চারটি মিশন চালাচ্ছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে আছে দূতাবাস। এছাড়া নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস ও মিয়ামিতে কনস্যুলেট জেনারেল অফিস। এ মিশনগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বাংলাদেশিদের কনস্যুলার সেবা দেওয়ার দায়িত্ব অর্পিত। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের ৬টি, পাকিস্তানের ৪টি মিশন রয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের অফিস স্থাপনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, মিশিগানে কনস্যুলেট জেনারেলের অফিস হলে স্থানীয় ও জাতীয় প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম রপ্তানিকারক রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে মিশিগান। ২০২২ সালে এখানকার রপ্তানি খাত প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। এখানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, আইটি সেবা ও কৃষিপণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে আয়ারল্যান্ডের শহর ডাবলিনে মিশন স্থাপনের যৌক্তিতা হিসাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ইউরোপের অন্যতম প্রগতিশীল, প্রযুক্তিনির্ভর এবং শিক্ষাবান্ধব দেশ আয়ারল্যান্ড। এখানে দূতাবাস স্থাপন হলে আইটি, স্বাস্থ্যসেবা ও উচ্চশিক্ষা খাতে প্রবেশাধিকারে সহায়ক হবে।
জার্মানির শহর ফ্রাঙ্কফুর্টে মিশন স্থাপন সম্পর্কে বলা হয়, ইউরোপের অর্থনৈতিক হৃৎপিণ্ড ফ্রাঙ্কফুর্টে কনস্যুলেট জেনারেলের অফিস স্থাপন মানে শুধু জার্মানিতে বিপুল প্রবাসী বাংলাদেশির সেবা প্রদান নয়, বরং সেখানকার বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাজারে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া।
এছাড়া আর্জেন্টিনার শহর বুয়েন্স এইরেস প্রসঙ্গে বলা হয়, লাতিন আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি আর্জেন্টিনায় মিশন স্থাপন বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য প্রবেশ, কৃষিভিত্তিক অংশীদারত্ব এবং দক্ষিণ গোলার্ধে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

