Logo
Logo
×

শেষ পাতা

চাকসুতে শিবির সমর্থিত প্যানেলের জয়

নেপথ্যে ছাত্রলীগের ভোট ও ছাত্রদলের অনৈক্য!

শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার

শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নেপথ্যে ছাত্রলীগের ভোট ও ছাত্রদলের অনৈক্য!

দীর্ঘ প্রায় ৪৪ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) নেতৃত্বে ফিরেছে ছাত্রশিবির। বুধবার অনুষ্ঠিত চাকসু নির্বাচনে বড় ধরনের জয় পেয়েছে সংগঠনটি। প্রায় ৩৬ বছর পর অনুষ্ঠিত ভোটে চাকসুর ২৬ পদের ২৪টিতেই শিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। এর আগে ১৯৮১ সালে চাকসু নির্বাচনে সর্বশেষ জয় পেয়েছিল শিবির।

এবারের নির্বাচনে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের জয়ের নেপথ্যে ছাত্রদলের অনৈক্য, সমন্বয়হীনতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দুই বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়া, নির্বাচনের তিন দিন আগে এক নেতাকে বহিষ্কার, নিজেদের মধ্যে দলাদলি ও গ্রুপিং-এসব কাজ করেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া অনেকেই মনে করেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ভোটও ‘গোপন সমঝোতায়’ গেছে শিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীদের বাক্সে। অতীতে দায়ের হওয়া মামলা থেকে ছাত্রলীগের যেসব নেতা আসামি হয়েছেন, তাদের অব্যাহতি দেওয়ার প্রলোভন, শিবির প্যানেলের অনেকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে জড়িত থাকাসহ নানা কারণে তাদের ভোট পেয়েছে শিবির। ছাত্রদলের সাবেক এবং বর্তমান নেতাদের অনেকে এমনটাই মনে করছেন।

তাদের মতে, এসব কারণেই শিবির বড় জয় পেয়েছে। চবি ছাত্রদল এই নির্বাচনে প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ তুলেছে। তবে ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়া মোটা দাগে কোনো অভিযোগ নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারেনি তারা। শত শত গণমাধ্যমের চোখ এড়িয়ে এই নির্বাচনে কারচুপির তেমন কোনো সুযোগ ছিল না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির বর্তমান যুগ্ম-আহ্বায়ক সাইফুদ্দিন সালাম মিঠু যুগান্তরকে বলেন, ‘ছাত্রশিবিরের প্যানেলে যারা এবার চাকসুতে নির্বাচন করেছেন, তাদের কেউ কেউ অতীতে ছাত্রলীগ করেছেন। এ কারণে তাদের সঙ্গে শিবিরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আমরা জানতে পেরেছি, অতীতে চবিতে খুনোখুনির অনেক ঘটনা আছে, যেগুলোয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আসামি। সেসব মামলা থেকে ছাত্রলীগের ছেলেদের নাম কাটার প্রলোভন দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে প্রশাসনও এই নির্বাচনে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে। যে কারণে ছাত্রদল চাকসুতে হেরেছে বলে আমি মনে করি।’ সাবেক এই ছাত্রদল নেতা ছাত্রদলের গ্রুপিং বা দলাদলির কারণে হারের অভিযোগটি সত্য নয় বলে মন্তব্য করেন।

এদিকে শিবিরের দাবি, বুধবার অনুষ্ঠিত চাকসু নির্বাচনে শিবিরের এই বিজয়ের নেপথ্যে তাদের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, ইস্পাতকঠিন ঐক্য, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা কাজ করেছে। ছাত্রশিবিরের নবনির্বাচিত ভিপি মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেন রনি জয়লাভের পর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, সাধারণ ছাত্ররা তাদের ওপর আস্থা রেখেছেন বলেই ভোট দিয়েছেন।

চাকসুর সাবেক নেতারা নবনির্বাচিত ভিপি-জিএসসহ নেতৃবৃন্দকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। নতুন সংসদ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে যেন ভালোভাবে কাজ করেন, সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।

সূত্র জানায়, দুই বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের ৫ সদস্যের কমিটি দেওয়া হয়। ওই কমিটিতে আলাউদ্দিন মহসিন সভাপতি এবং আবদুল্লাহ আল নোমানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার কথা থাকলেও দুই বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। দুই মাস আগে প্রায় আড়াইশ জনের কমিটির একটি তালিকা দেওয়া হলেও চাকসু নির্বাচনের আগে দলাদলির ভয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেনি কেন্দ্র। উলটো শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে নির্বাচনের তিন দিন আগে ৫ জনের কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি মামুনুর রশীদ মামুনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এসব বিষয়ও ছাত্রদলের হারের নেপথ্যে কাজ করেছে বলে জানান দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা।

সর্বশেষ ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত চাকসু নির্বাচনে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের প্যানেল থেকে জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের চবি শাখার তৎকালীন সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য আজিম উদ্দিন আহমেদ। তিনি নবনির্বাচিত নেতৃত্বকে অভিনন্দন ও স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘শিবির তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা, সমন্বয় ও ঐক্যের জন্য বিজয় অর্জন করেছে বলে আমি মনে করি। আর ছাত্রদল সমন্বয়হীনতা, গ্রুপিং ও দলাদলির কারণে পিছিয়ে পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্রদল চাকসু নির্বাচনে ভোট কারচুপির যে অভিযোগ করেছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, এত গণমাধ্যমের চোখ ফাঁকি দিয়ে ম্যানিপুলেট করার সুযোগ ছিল না। ৫/১০ শতাংশ এদিক-ওদিক করা যেতে পারে। কিন্তু এই নির্বাচনে সাধারণ ছাত্রদের মতামতের প্রতিফলনই ঘটেছে।

চতুর্থ চাকসুতে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের মজহারুল হক শাহ চৌধুরী। ওই নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ছাত্রশিবিরের জসিম উদ্দিন সরকার। মজহারুল হক শাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন চাকসু নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় জাতি অনেক যোগ্য নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। চাকসু হচ্ছে চবির সব ছাত্রছাত্রীর সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান। আমি আশা করি, সব মতের শিক্ষার্থীদের অধিকার ও দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করবেন নবনির্বাচিত নেতারা।’ চাকসু নির্বাচন আয়োজন করায় তিনি চবি প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানান এবং প্রতিবছর যাতে এই নির্বাচন আয়োজন করা হয়, সেই প্রত্যাশা করেন।

সাবেক এক চাকসু নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক নেতাকে ফোনে কল করে জানতে চেয়েছিলেন, যেহেতু তাদের প্রার্থী নেই, ডাকসুতে তাদের ভোট প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী। ওই নেতা বলেছেন, শিবিরকে তারা ভোট দেবেন। ৫ আগস্টের পর জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে মিলে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নিধনে বিএনপি-ছাত্রদল যে কাজ করেছে, তার ‘শিক্ষা’ দিতেই তারা শিবিরের প্যানেলকে ভোট দিয়েছে-এমনটাই দাবি করেন ওই নেতা। একইভাবে চাকসুতেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ছাত্রলীগের ভোট শিবিরের প্যানেলে গেছে। যে কারণে ছাত্রদলের ভরাডুবি হয়েছে।

সর্বশেষ চাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল থেকে সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন চবি ছাত্রদল নেতা সালাহউদ্দিন মো. রেজা। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের নির্বাচিত সভাপতি ও দৈনিক ইত্তেফাকের চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের একটি গোপন যোগসাজশ ছিল। অনেক শিবিরনেতা ছাত্রলীগের পদপদবিতে ছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে প্রকাশ হয়। ডাকসু নির্বাচনে তাদের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছিল। একইভাবে চাকসুতেও শিবির-ছাত্রলীগের মধ্যে গোপন সমঝোতার কারণে ছাত্রলীগের ভোট শিবিরের প্যানেলে গেছে বলে আমার বদ্ধমূল ধারণা।’ তিনি আরও বলেন, ‘চাকসুতে শিবিরকে জেতাতে শিবিরের সাবেক নেতা যারা বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন স্তরে কাজ করছেন, তারা নানা কৌশলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। পক্ষান্তরে ছাত্রদলের ক্ষেত্রে বিএনপির নেতৃত্ব ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। ছাত্রদলের ভরাডুবির নেপথ্যে এটিও বড় কারণ হতে পারে।’

ফ্ল্যাশব্যাক : চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পাহাড়ঘেরা পরিবেশে ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে। ওই নির্বাচনে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের মোহাম্মদ ইব্রাহীম ও আবদুর রব। ১৯৭২ সালে দ্বিতীয় চাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের শামসুজ্জামান হীরা ভিপি এবং জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে জাসদ ছাত্রলীগের এসএম ফজলুল হক ভিপি এবং গোলাম জিলানী চৌধুরী জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে চতুর্থ নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন জাসদ ছাত্রলীগের মজহারুল হক শাহ চৌধুরী এবং জিএস নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের জমির চৌধুরী।

১৯৮১ সালে পঞ্চম নির্বাচনে ভিপি ও জিএস হিসাবে নির্বাচিত হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জসিম উদ্দিন সরকার ও আবদুল গাফফার। ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ নির্বাচনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রার্থী হিসাবে জাতীয় ছাত্রলীগের নাজিম উদ্দিন ভিপি নির্বাচিত হন। জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি আজিম উদ্দিন আহমদ। প্রায় ৩৬ বছর পর ১৫ অক্টোবর বুধবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শিবির সমর্থিত প্যানেল ২৬টি পদের মধ্যে ভিপি-জিএসসহ ২৪টি পদেই নির্বাচিত হয়।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম