উলফত রানার জাদুঘর যেন খুদে বিশ্ব
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এ যেন এক খুদে পৃথিবী! চারতলা ভবনের নিচ থেকে উপর-থরে থরে সাজানো শত থেকে আটশ বছরের পুরোনো জিনিসপত্র। আটশ বছর আগের সবচেয়ে ছোট্ট কুরআন শরিফ থেকে শুরু করে ক্যামেরা, প্রাচীনতম মডেলের সাত হাজারের বেশি হাতঘড়ি, নানা দেশের কয়েন, রং-বাহারি আসবাবপত্র, কেরোসিনচালিত ফ্রিজ, পাখা-কী নেই সেখানে। বিশ্বের সবচেয়ে ছোট্ট ছাপাযন্ত্র, দ্বিতল বাসন, রাজা-রানীদের আসবাবপত্র, নানা দেশের দুরবিন, পুঁথি-পুস্তক-কত যে বৈচিত্র্য। এমন দেশ নেই যেখানকার কোনো না কোনো জিনিসের দেখা মিলবে না এখানে! আর প্রতিটি সংগ্রহের নেপথ্যেই রয়েছে নানা মজাদার গল্প। রাজধানীর দক্ষিণ মান্ডায় ওই সংগ্রহশালা বীর মুক্তিযোদ্ধা উলফত রানার।
উলফত রানার বয়স ৬৭ বছর। কবি ও সাহিত্যিক হিসাবেও রয়েছে তার পরিচয়। ছোট বেলা থেকেই ঘুরেছেন দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে। মনের খোরাক জোগানের সঙ্গেই কুড়িয়েছেন এসব সামগ্রী। সাজানোর স্থান না পেয়ে এসব মূল্যবান সামগ্রীর ৭০ শতাংশই রেখেছেন স্তূপ করে। সোফা, খাট, ডাইনিং টেবিলসহ যত আসবাবপত্র রয়েছে-সবের নিচে, ভেতরে গোডাউনেও রাখা আছে নানা নিদর্শন। দেখতে গিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
এ বয়সেও তিনি সংগ্রহের কাজ করে যাচ্ছেন। দেশ হোক কিংবা বিদেশ-নেশাটুকু তাড়া করলেই ছুট দেন উলফত রানা। শুধু মাঝেমধ্যে অবসন্ন হয়ে পড়েন একটাই কারণে। ‘যখন আমি থাকব না, তখনো আমার সংগ্রহ থাকবে। কিন্তু এ জন্য আমার পুরো বাড়িটা জাদুঘরের ন্যায় সাজাতে চাই। অথচ কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। একেকটি রুমে যে পরিমাণ নিদর্শন রয়েছে, তার দুই-তিনগুণ বেশি নিদর্শন স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সরকার বা সমাজের কোনো বিত্তশালী সহৃদয়বান ব্যক্তি এগিয়ে আসলে, আমার স্বপ্নটা পূরণ হতো।’ কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস, নিশ্চয় কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে।
উলফত রানা স্ত্রী নূর-ই-ফাতেমাকে হারিয়েছেন চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি। দীর্ঘ ৩০ বছর অসুস্থ স্ত্রীর সেবা-যত্ন করেছেন। দেশে এইডসবিরোধী আন্দোলন প্রথম শুরু করেছিলেন তিনি। এছাড়া নানা জায়গায় নিজের সংগ্রহ নিয়ে ঘোরার সুবাদে বহু বিশিষ্ট মানুষের কাছাকাছি এসেছেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানসহ গুণী মানুষের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। তবু এত বছরেও অর্থাভাবে নিজের স্বপ্ন যথাযথ রূপ দিতে পারেননি।
সরেজমিন উলফত রানার চারতলা সংগ্রহশালাটি দেখতে কয়েকদিন সময় লাগে। এক একটি নিদর্শনের বর্ণণাসহ জানতে গেলে-সময় লাগবে সপ্তাহের বেশি। দেয়ালঘড়ি, হাতঘড়ি, পকেটঘড়ি অর্থাৎ সব ঘড়ি মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজারের বেশি। আমেরিকায় সে সেলাই মেশিন আবিষ্কার হয়েছিল, তা উলফত রানার সংগ্রহে আছে। শত শত বছরের পুরোনো যা কেরোসিন দিয়ে চালানো হতো-ফ্রিজ, পাখা ইত্যাদি তার এক একটি কক্ষে অযত্নে পড়ে আছে। দেশে প্রথম যে টেলিভিশন এসেছিল, তাও তার সংগ্রহে। ভাল্ব সিস্টেমের রেডিওসহ প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো ক্যামেরা রয়েছে তার কক্ষে। মিনি কলের গান শুনতে পাবেন, তার একেকটি তলায় গেলে। বেশ কয়েকটি মিনি কলের সেট রয়েছে, যা আজও বাজানো যায়।
তার সংগ্রহশালায় রয়েছে দোতলা প্লেট, শত শত বছর পুরোনো টিফিন ক্যারিয়ার। দোতলা প্লেটের নিচের ভাগে দুটি অংশ। একটি ছিদ্র রয়েছে, যেখান দিয়ে প্লেটের নিচে গরম পানি রাখার ব্যবস্থা আছে। ছিদ্রের সাহায্যে গরম পানি ঢেলে রাখা হতো। এরপর ছিদ্রের মুখ বন্ধ করে খাবার পরিবেশন করা হতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জমিদার-বাদশাহরা খাবার খেতেন গরম গরম। তার সংগ্রহে রয়েছে, শত বছর পুরোনো ডিকশনারি, পত্রিকা, খাজনার দলিল। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই-যে দেশের কয়েন-টাকা তার সংগ্রহে নেই। তামার, স্বর্ণের কয়েন রয়েছে। শত বছরের পুরোনো কাঠের টেলিফোনসহ অসংখ্য টেলিফোন রয়েছে।
টেলিফোনের শুরুর কাল থেকে আজ অবধি যে ধরনের সেট ব্যবহৃত হচ্ছে-সেগুলো সংগ্রহে রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম ছাপাখানা তার সংগ্রহে রয়েছে।
উলফত রানার সংগ্রহে রয়েছে মাত্র ১.৯ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১.৩ সেন্টিমিটার প্রস্থ এ কুরআন শরিফ, এক কথায় অনন্য। পিতলের কাভারে রাখা কুরআন শরিফটি চোখে পড়তেই মনটা শান্ত হয়ে আসে। হাতের নখের ওপর রাখা যায় পুরো কুরআনটি। উলফত রানার ভাষ্য, পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম কুরআন শরিফ এটি। প্রায় ৮শ বছর পুরোনো। সঙ্গে আরও দুটি ছোট্ট কুরআন শরিফ রয়েছে।
বিশ্বের যে কোনো জাদুঘরে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে-নির্ধারিত দূরত্বে সাজিয়ে রাখা হয়েছে একেকটি নিদর্শন।
উলফত রানার বাড়িতে ঢুকলে মনে হবে উলটো। শুধু জায়গার অভাবে এত মূল্যবান নিদর্শনও ফেলে রাখা হয়েছে স্তূপ করে। তার মৃত্যুর পর এসব নিদর্শনের কী হবে-এই ভেবে তার ঘুম আসে না।
উলফত রানার এক ছেলে-এক মেয়ে রয়েছে। তাদের অবসর কাটে বাবার এ সংগ্রহশালা ঘিরে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার সাদমান শাকিব ও মেয়ে নূরে-জান্নাত-রিজা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যে কোনো মূল্যে বাবার এ সংগ্রহশালা রক্ষা করবেন। মেয়ে দেশের একটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। ছেলে সাদমান শাকিব বিশ্বমানের এন্টিসক বিশেষজ্ঞ। শাকিব যুগান্তরকে বলেন, ‘বাবার এ সংগ্রহশালাকে আমি এবং আমার বোন জীবনভর ধরে রাখব। তবে অনুরোধ, সরকার এবং হৃদয়বান ব্যক্তিরা যেন বাবার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসে।’

