Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ড

দুই সংস্থার তদন্তে বিশাল ফারাক

সাইফ আহমাদ

সাইফ আহমাদ

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুই সংস্থার তদন্তে বিশাল ফারাক

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ড। ফাইল ছবি

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তদন্ত কমিটি নাশকতার কোনো প্রমাণ পায়নি। বেবিচকের তদন্তে উঠে এসেছে, আগুনের সূত্রপাত কার্গো ভিলেজ থেকেই। আর কার্গো ভিলেজ ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের। অন্যদিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেবিচকের অব্যবস্থাপনা, ঝুঁকিপূর্ণ মালামাল সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তার চরম ঘাটতির ফলে ঘটেছে এ অগ্নিকাণ্ড। প্রতিবেদনে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির অতিরিক্ত তাপমাত্রা বা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটই ধ্বংসযজ্ঞের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উঠে এসেছে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা অব্যবস্থাপনার ভয়াবহ চিত্র।

বিমানের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গত ৩ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের কাছে দাখিল করে। অন্যদিকে বেবিচকের তদন্তও শেষ করে এনেছে। তাদের প্রতিবেদনটি এ সপ্তাহেই চেয়ারম্যানের দপ্তরে দাখিল করবে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেবিচকের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে।

গত ১৮ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সরকারের অর্থ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস, বেবিচক ও বিমান। পাঁচটি কমিটির মধ্যে বিমানের তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেছে। প্রতিবেদন দাখিলের তালিকায় রয়েছে বেবিচক। বাকি তিনটি কমিটির প্রতিবেদন কবে দেওয়া হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।

গত ২১ অক্টোবর গঠিত বেবিচকের তদন্ত কমিটি ২৩ অক্টোবর পুনর্গঠিত হয়। কমিটিতে যুক্ত করা হয় কাস্টমসের প্রতিনিধি। ৭ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে অগ্নিকাণ্ডের উৎস ও কারণ নিরূপণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ, দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শনাক্ত, বেবিচকের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ভূমিকা ও ভবিষ্যতে অনুরূপ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে কমিটি গঠনের পর ১৯ দিন পেরিয়ে গেলেও তা জমা দেয়নি কমিটি। চলতি সপ্তাহের শেষ নাগাদ এ প্রতিবেদন চেয়ারম্যানের দপ্তরে জমা দেবে তদন্ত কমিটি-যুগান্তর তা নিশ্চিত হতে পেরেছে।

বেবিচকের সদস্য (নিরাপত্তা) ও তদন্ত কমিটির সভাপতি এয়ার কমোডর আসিফ ইকবাল খান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের ৭ দিন সময় দেওয়া হলেও পরে আরও বিস্তারিত তদন্ত করতে বলা হয়েছে। যেহেতু ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের কথা বলা হয়েছে। তাই ক্ষয়ক্ষতির হিসাব সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট পক্ষের তথ্যের অপেক্ষায় সময় লেগেছে। আমরা এখন তদন্তের শেষ পর্যায়ে। প্রাথমিকভাবে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এ ঘটনায় নাশকতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সিসিটিভি ফুটেজ, নিরাপত্তা লগসহ সব দিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আগুন লাগার সময় কোনো অননুমোদিত প্রবেশ বা সন্দেহজনক কার্যক্রম ঘটেনি। আগুনের উৎস কার্গো ভিলেজের ভেতরেই, যেখানে কুরিয়ার সেকশন অবস্থিত। ঘটনাস্থলে বৈদ্যুতিক সংযোগ, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সম্ভাব্য কারণগুলো আমরা পরীক্ষা করছি। তবে এখনই কোনো নির্দিষ্ট কারণ বা দায় নির্ধারণ করা সমীচীন নয়। কারণ রিপোর্টটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আশা করছি, এই সপ্তাহের মধ্যেই বিস্তারিত বিশ্লেষণসহ তদন্ত প্রতিবেদন চেয়ারম্যানের দপ্তরে জমা দিতে পারব।

তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায়, বেবিচকের নিজস্ব নীতিমালা সিভিল এভিয়েশন প্রসিডিউর ডকুমেন্ট (সিপিডি)-৩৩ অনুযায়ী, বিমানবন্দরের ফায়ার ফাইটিং সুবিধা, ডেঞ্জারাস গুডস ব্যবস্থাপনা এবং সার্টিফিকেশন প্রদানের দায়িত্ব ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড রেগুলেশনস (এফএসআর) ডিভিশনের। এই ডিভিশনের দায়িত্ব আইকাও’র নির্দেশনা অনুযায়ী অপারেশনাল সেফটি কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা। এছাড়া আইকাও’র এনেক্স ৬ এবং এনেক্স ১৪ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ডেঞ্জারাস গুডস ইন্সপেকশন ও সার্টিফিকেশন, বিল্ডিং ফায়ার নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতের দায়ভারও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর বর্তায়।

বেবিচকের এফএসআর বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে জানান, ডেঞ্জারাস গুডস ইন্সপেক্টর যখন পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, তখন পর্যাপ্ত পরিমাণ ফায়ার এক্সটিংগুইশার (অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র) ছিল। সর্বশেষ ইন্সপেকশন করা হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। সে সময় কোনো ত্রুটি শনাক্ত হয়নি। ইন্সপেকশন প্রতিবেদনে ডেঞ্জারাস গুডস আলাদাভাবে সংরক্ষিত ছিল মর্মে বলা হয়। বর্তমানে ডেঞ্জারাস গুডস ইন্সপেক্টরের সংখ্যা কম। তবে শিগগিরই নতুন জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে।

এদিকে আগুনের ঘটনার দিন তদন্ত কমিটি করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। ওই কমিটি পাঁচ কার্যদিবসের মধ্য তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও ১১ কার্যদিবস পর নভেম্বর ৩ তারিখ বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, আগুনের উৎপত্তি হয় ‘কুরিয়ার বিল্ডিং’ নামে পরিচিত কাঠামোর ভেতর থেকে। যা আগে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএইএবি) নির্মাণ ও পরিচালনা করত। টিনের ছাউনি দেওয়া ওই ভবনের ভেতরে লোহার গ্রিল ঘরে প্যাক করা অবস্থায় রাখা ছিল আমদানি করা ইলেকট্রনিক পণ্য। ছিল ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। অথচ এসব ব্যাটারি ‘বিপজ্জনক পণ্য’ (ডেঞ্জারাস গুডস) হিসেবে পরিচিত, যা নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সেখানে এমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

বিমানের সূত্রমতে, এক লাখ ৫৮ হাজার বর্গফুট আয়তনের কমপ্লেক্সটি প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক। বিমান কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন থেকেই বেবিচককে ডেঞ্জারাস গুডসের জন্য আলাদা ঘর তৈরি করে দেওয়ার জন্য চিঠি দিলেও বেবিচক সেটি করেনি। আগে থেকেই সতর্ক করা সত্ত্বেও লিজ অনুমোদন, কাঠামো নির্মাণ অনুমতি ও পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণে নিরাপত্তা মানদণ্ড নিশ্চিত করেনি। এটি তাদের দায়িত্ব ছিল।

দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে পশ্চিম পাশের একটি অংশ থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করে। এটি ছিল ডিএইচএলের লিজ নেওয়া স্থান। ২টা ১৯ মিনিটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে।

বিমানের তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আগুনের উৎসে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি কারণ ভবনের টিন দেওয়াল ভাঙার উপযুক্ত যন্ত্র বিমানবন্দরে ছিল না। পরে ফায়ার সার্ভিস বুলডোজার এনে দেওয়াল ভেঙে আগুনের উৎসে পৌঁছায়। কার্গো ভিলেজের আশপাশে কোনো ফায়ার হাইড্রেন্ট ছিল না, ফলে পানি সংগ্রহ করতে হয় দূরের স্থান বিমান হ্যাঙ্গার, ডোমেস্টিক টার্মিনাল, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সুইমিং পুল ও নিকটবর্তী পুকুর থেকে।

এদিকে অকেজো ছিল বিমানবন্দরে ফায়ার স্প্রিংকলার (অগ্নিনির্বাপণের যন্ত্র)। আগুন ছড়িয়ে পড়লেও কোনো ফায়ার স্প্রিংকলার কাজ করেনি। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ২টা ১৯ মিনিটে বিমানবন্দরের নিজস্ব দমকল (এআরএফএফ) টিমকে খবর দেওয়া হয়, কিন্তু জরুরি প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিসকে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হয়নি। বিমানবন্দরে কর্মরত একজন ফায়ার কর্মী যুগান্তরকে জানান, আগুন লাগার পর প্রথম কয়েক মিনিট আমরা কোনো দিকনির্দেশনা পাইনি। স্প্রিংকলার কাজ করেনি, ফলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

বিমানের তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বিপজ্জনক পণ্য (ডেঞ্জারাস গুডস) রাখার জন্য বিমানবন্দরের উত্তর পাশে অব্যবহৃত ২১ হাজার ৮০০ বর্গফুট আনসার ব্যারাককে নতুন গুদাম হিসাবে ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম