৮ দলের সংবাদ সম্মেলন
সরকার একটি দলের ফাঁদে পা দিয়েছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের আয়োজনকে ‘ফাঁদ’ অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যবশত বুঝে হোক, না বুঝে হোক, ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে হোক-সরকার একটি দলের ফাঁদে পা দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে এবং সংস্কারকে প্রায় গুরুত্বহীন করে তুলেছে। এর আগেও আমরা দেখেছি যে, এ সরকার ওই দলটির প্রতি নানাভাবে তাদের আনুগত্য অথবা তাদের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। সেটা শুরু হয়েছে লন্ডনে গিয়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার মাধ্যমে। গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর মগবাজারে আল ফালাহ মিলনায়তনে আন্দোলনরত ইসলামি ৮ দল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
ডা. তাহের বলেন, একসঙ্গে ভোট হলে ‘সাশ্রয়ী’ হবে-প্রধান উপদেষ্টার এটি ‘খোঁড়া যুক্তি’। এর কোনো যথার্থতা নেই। জনগণের স্বার্থেই দেশের বাজেট। তিনি বলেন, যদি গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে গণভোটের গুরুত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। সেই সঙ্গে সংস্কারসংক্রান্ত মূল ইস্যুটিও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। কার্যত গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। এখনো সময় আছে। প্রধান উপদেষ্টা গণভোটের তারিখ পৃথকভাবে নতুন করে ঘোষণা করবেন এবং সেই গণভোটের রায়ের ভিত্তিতেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করবেন। এই সরকার আর নিরপেক্ষ নয়-উল্লেখ করে এই জামায়াত নেতা বলেন, তিনজন উপদেষ্টার কুপরামর্শে সরকার একটি বড় দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। তারা একটি নির্দিষ্ট দলের হয়ে কাজ করছেন এবং ভুল তথ্য দিয়ে সরকারকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সুকৌশলে অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। তিন উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে মিসগাইড করছেন। আমরা এ তিন উপদেষ্টার অপসারণ দাবি করছি। তাদের নাম আমরা আজ বলছি না, প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠিয়ে দেব।
ড. ইউনূসের ভাষণে ‘জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি’ অভিযোগ করে ডা. তাহের বলেন, ৮ দলের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। আজকে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। ঢাকার বিক্ষোভ কর্মসূচি এ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রিপ্লেস হলো। আর ঢাকার বাইরের বিক্ষোভ কর্মসূচি যথারীতি চলছে এবং আজ বিকাল পর্যন্ত চলবে।
জামায়াত নেতা বলেন, ‘প্রশাসনে কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে এবং সেখানে ওই বিশেষ দলের প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োগের চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে প্রশাসনের সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।’
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য অধ্যাদেশের পরিবর্তে আদেশ জারি করায় সরকারকে সাধুবাদ জানান ডা. তাহের। তিনি বলেন, সংস্কার কমিশন ৩১টি দলের সমন্বয়ে মূল্যবান সময় ব্যয় করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে এবং তাতে স্বাক্ষর করেছে। জাতি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বুকভরা আশা নিয়ে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমরা যে সংস্কারের ওপর স্বাক্ষর করেছিলাম এর ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে একটি দল এই সংস্কারের প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করেছে। শুরু থেকেই তারা সংস্কার চায়নি।
তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ না করে একটি দলের সঙ্গে কম্প্রমাইজ করে জনগণের স্বার্থ বাদ দিয়ে ওই দলের স্বার্থে অনেক পরিবর্তন এনে প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দিয়েছেন। ফলে জনগণ এবং দেশবাসী হতাশ হয়েছে। সংস্কার কমিশন যে আঙ্গিকে প্রস্তাব করেছিলেন, সেখান থেকে সনদের ব্যাপারে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেটা সঠিক হয়েছে বলে আমরা মনে করি না। আমরা মনে করি, আমাদের সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছিল হুবহু সেটার ভিত্তিতে আদেশ দেওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল।
ডা. তাহের আরও বলেন, সংস্কার কমিশন পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের লক্ষ্যে জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়ার জন্য হ্যাঁ-না ভোট নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। সরকার সংস্কার কমিশনের সুপারিশকে চারটি ভাগে ভাগ করে গণভোট নেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছে-তা জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক জটিলতায় ফেলে দিয়েছে। ভোটারদের পয়েন্ট বিশ্লেষণ করে তাদের মত ঠিক করাটা কঠিন হবে এবং জটিলতা তৈরি হবে। সরকার বিএনপির নোট অব ডিসেন্টকে একোমডেট করার জন্যই চারটি ভাগে ভাগ করে হ্যাঁ-না ভোটের ব্যবস্থা নিয়েছে। দেশবাসী মনে করে এটা আইনের বিপরীত, ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিপরীত।
ডা. তাহের বলেন, ঐকমত্য কমিশন বলেছিল, সনদের আদেশের পর যারাই নির্বাচিত হয়ে সরকারে আসবেন তাদের ২৭০ দিনের মধ্যেই এগুলোকে সাংবিধানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর যদি না করে এটা অটোমেটিকলি গৃহীত হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় সেই বাধ্যবাধকতার জায়গাটি তারা রাখেননি। এতে বিএনপির দাবিকে পূরণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সব দলের সঙ্গে আলোচনা না করেই নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করে দেওয়া এবং বিভিন্ন সময়ে তাদের আচরণে একটি দলের দাবির প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা-এসব কিছু মিলে জাতির কাছে প্রতীয়মান হয় এ সরকার এখন আর নিরপেক্ষ নয়। এ সরকার একটি দলের প্রতি অনুগত বা একটি দলকে ক্ষমতায় আনার জন্য যেনতেন প্রকারের নির্বাচন আয়োজনের জন্য তাদের প্রচেষ্টা আছে।
ডা. তাহের বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে রোজার আগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক-এ ব্যাপারে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সেজন্যই আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য মাঠে কাজ করছি। কিন্তু যে কারণে জনগণ বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ পিরিয়ডে ভোট থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, ঠিক একইভাবে আরেকটি নির্বাচনের মহড়া চলছে কিনা, আরেকটি পরিকল্পিত এবং পূর্বনির্ধারিত নির্বাচনের রায়ের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে কিনা-এ ব্যাপারে জনগণ ও আমাদের মনে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সরকারের আচরণে নির্বাচন অবাধ হওয়ার ব্যাপারে আমাদের মনে শঙ্কা ও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।
সরকার উভয় পক্ষকে খুশি করতে ব্যালেন্স করেছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুল্লাহ তাহের বলেন, ব্যালেন্স করা তার কাজ নয়, জাতির স্বার্থরক্ষার জন্য ড. ইউনূসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম ও কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা তোফাজ্জল হোসাইন মিয়াজী, খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার চৌধুরী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মুহাম্মাদ ইউসুফ সাদিক হাক্বানী, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সহসভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র (জাগপা) ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ইকবাল হোসেন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নিজামুল হক নাঈম প্রমুখ।
বাংলাদেশ নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে : কুমিল্লা ব্যুরো জানায়, শুক্রবার সন্ধ্যায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম চৌমুহনী বাজারে মুজিবুল হক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নির্বাচনি জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। সেখানে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন ও বাংলাদেশকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। পত্রিকায় দেখলাম নিরাপত্তা উপদেষ্টা ভারতে গিয়েছেন। সেখানে কি আলোচনা হয়েছে, সংবাদ সম্মেলন করে সরকারকে পরিষ্কার করতে হবে। জীবন ও রক্ত দিয়ে ভারতের আধিপত্যবাদকে বাংলার মানুষ তাড়িয়েছে। ভারতের আধিপত্যবাদ ও বশ্যতা বাংলার মানুষ আর গ্রহণ করবে না। এ সরকার যদি ভারতের অন্যায় আবদার ও অন্যায় সিদ্ধান্তে নতি স্বীকার করতে চায়, তাহলে আপনাদের পরিণতিও শুভ হবে না।
শ্রীপুর ইউনিয়ন জামায়াত আয়োজিত এ জনসভায় প্রধান বক্তা ছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাও. আবদুল হালিম। বক্তৃতা করেন, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শাহজাহান, আমেরিকার নিউইয়র্কের মুনা কনভেনশন সেন্টারের ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ও বায়তুল মামুর মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন। শ্রীপুর ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মাওলানা আবদুল হাকিম সভাপতিত্ব করেন। পরিচালনা করেন জামায়াত নেতা মনির হোসাইন ও রবিউল হোসেন মিলন।
