Logo
Logo
×

শেষ পাতা

পুলিশের নতুন পোশাকে কলঙ্ক ঘোচানোর চেষ্টা

সব মেট্রোপলিটন পুলিশ ও বিশেষায়িত ইউনিটকে কাপড় দেওয়া হয়েছে -এআইজি মিডিয়া

ইমন রহমান

ইমন রহমান

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পুলিশের নতুন পোশাকে কলঙ্ক ঘোচানোর চেষ্টা

জুলাই আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে রক্ষায় বিতর্কিত ভূমিকা পালনকারী পুলিশবাহিনী পোশাক (ইউনিফর্ম) বদল করে কলঙ্ক ঘোচানোর চেষ্টা করছে। শনিবার থেকে সারা দেশের আটটি মহানগর ও বিশেষায়িত ইউনিটের সদস্যরা প্রাপ্যতার ভিত্তিতে লৌহ রঙের নতুন পোশাক পরে ডিউটি করছেন। ইতোমধ্যে সব মেট্রোপলিটন পুলিশ ও বিশেষায়িত ইউনিটকে নতুন কাপড় দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব পুলিশ সদস্য নতুন পোশাক পাবেন বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।

তবে পুলিশের নতুন পোশাক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন আগের পোশাকই ভালো ছিল, নতুন পোশাক অর্থ অপচয় ছাড়া কিছু না। আবার কেউ বলছেন, নতুন পোশাকের ডিজাইন হয়েছে অসাধারণ। কেউ আবার প্রশ্ন তুলেছেন-পোশাক বদলালেই কি চাঙা হবে পুলিশের মনোভাব। নতুন পোশাক নিয়ে খোদ পুলিশ সদস্যদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

পুলিশের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোশাক বদল করে কার্যত কোনো লাভ হবে না। এটি চরিত্র কোনোদিন বদল করবে না। জনবান্ধব এবং পেশাদার পুলিশবাহিনী গড়ে তুলতে হলে সবার আগে দরকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের গ্যারান্টি। একই সঙ্গে সরকারের বেআইনি আদেশের ক্ষেত্রে তাদের না বলা শিখতে হবে।

সাবেক আইজিপি (পুলিশের মহাপরিদর্শক) মোহাম্মদ নুরুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, ‘ইউনিফর্ম বদল করে কী ফল আশা করছে, সেটা জানি না। প্রত্যক্ষভাবে ইউনিফর্মের সঙ্গে পারফরম্যান্সের কোনো সম্পর্ক নেই।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আচরণসহ পুলিশের বিরুদ্ধে থাকা আভিযোগগুলো ১০০ বছর ধরেই আছে। ইতোমধ্যে দুই থেকে তিন দফায় পুলিশের ইউনিফর্ম বদল হয়েছে; কিন্তু তাতে আচরণগত কোনো পরিবর্তন হয়নি।

ইউনিফর্ম বদল করে আচরণ পরিবর্তন হয়, পৃথিবীর কোথাও গবেষণা করে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে সাবেক আইজপি বলেন, শ্রীলংকায় পুলিশের ইউনিফর্ম ব্রিটিশ আমলে যা ছিল (খাকি রঙের), এখনো তাই আছে। তারা কোনো পরিবর্তন করেনি।

মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ও অপরাধ বিশ্লেষক মুহাম্মদ আব্দুল কাদের মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘এর আগেও পুলিশের পোশাক বদল হয়েছিল। কিন্তু চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে এবারের প্রেক্ষাপট অন্যবারের চেয়ে ভিন্ন। পুলিশের সংস্কার যদি শেষমেশ বাস্তবায়ন হয়, তাহলে পোশাক পরিবর্তন কিছুটা কাজে আসবে।’

জানা যায়, শনিবার থেকে দেশের সব মেট্রোপলিটন (মহানগর) ও বিশেষায়িত ইউনিটের কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এই নতুন পোশাক পরিধান করছেন। তবে জেলা পর্যায়ের পুলিশ ইউনিট এখনো নতুন পোশাক পায়নি। রোববার দিনভর রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন দেখা যায়, নতুন পোশাকে দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা। তাদের অনেকে নতুন পোশাকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। ডিএমপির কল্যাণ ও ফোর্স শাখার এসআই মো. গোলাম মোর্শেদ যুগান্তরকে বলেন, শনিবার এক সেট নতুন পোশাক পেয়েছি, ভালো লাগছে। আগেরটাও ভালো ছিল। তিনি জানান, আগে মোট চার সেট পোশাক ছিল। এখন এক সেট পেয়েছেন।

মহাখালী এলাকায় নতুন পোশাক পরে দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন আবাসিক এলাকা ও হাসপাতালের নিরাপত্তা প্রহরীরা একই রঙের পোশাক পরেন। তাছাড়া এর আগে যখন পুলিশের পোশাক পরিবর্তন হয়, তখন জাতীয় পর্যায়ে একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু এবার হঠাৎ করেই একদিন আগে পোশাক দিয়ে নামিয়ে দিয়েছে। কোনো প্রচার-প্রচারণার বিষয় এবার নেই। ফলে পোশাক দেখে কেউ বুঝতে পারে না সিকিউরিটি গার্ড নাকি পুলিশ।

অনুভূতি জানতে চাইলে আরেক পুলিশ সদস্য বলেন, যেহেতু সরকারি চাকরি করি, সেহেতু সরকার যেভাবে চাইবে, সেভাবেই চলতে হবে। এছাড়া কিছু বলার নেই।

ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, শনিবার পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের নতুন পোশাক সরবরাহের কাজ ২০ শতাংশ এগিয়েছে। আশা করছি, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রায় ৩৪ হাজার সদস্যের সবাইকে নতুন পোশাক সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

এদিকে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য পুলিশের নতুন পোশাক নিয়ে ফেসবুক পোস্টে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন, পুলিশের নতুন পোশাক যাচ্ছেতাই হইছে। আমাদের আমলারা একেবারেই যে বুদ্ধিহীন, এই পোশাক তার প্রমাণ। এদের না আছে বাহিনীর প্রতি ভালোবাসা-দরদ, না আছে চিন্তার ক্ষমতা। খাকি বা নীল পোশাকে ঘাম আর ধুলা দেখা যায়। পুলিশের পোশাক এমন হতে হবে, যা একই সঙ্গে আরামদায়ক, পরিচ্ছন্ন ও সাইকোলজিক্যাল ইম্প্যাক্ট তৈরি করতে পারে। আমার মতে, টিল কালার সবচেয়ে ভালো হবে বাংলাদেশের জন্য।

বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র‌্যাব) সাবেক সহসভাপতি মিজানুর রহমান শাহবাগ থানার ওসির সঙ্গে (নতুন ইউনিফর্ম পরিধান করা) ছবি তুলে তার ফেসবুক পেজে পোস্ট করে লিখেছেন, এতদিন ছবিতে পুলিশের নতুন পোশাক দেখে আমার তেমন পছন্দ হয়নি। তবে আজ সামনাসামনি দেখে বেশ ভালোই লেগেছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, সিভিল পুলিশ ছাড়া অন্যদের ইউনিফর্ম দেওয়া হয়। সরকারিভাবে প্রতিবছর প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের জন্য তিন সেট শার্ট (হাফ হাতা) ও প্যান্ট বরাদ্দ রয়েছে। এছাড়া দুটি ফুলহাতা শার্ট এবং দুই বছর পরপর একটি জ্যাকেট দেওয়া হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, সব মেট্রোপলিটন পুলিশ আর বিশেষায়িত ইউনিটকে কাপড় দেওয়া হয়েছে। ১৫ নভেম্বর থেকে তারা নতুন পোশাক পরা শুরু করেছেন। পর্যায়ক্রমে সবাই নতুন পোশাক পাবেন।

উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিতর্কিত ভূমিকা সব মহলে সমালোচিত হয়েছে। বিশেষ করে পুলিশের ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার টিকিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় তারা। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে পুলিশ। সারা দেশেই পুলিশ আত্মগোপনে চলে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে পুলিশি কার্যক্রম। তবে সব মহল থেকে দাবি ওঠে পুলিশ সংস্কারের। গঠিত হয় পুলিশ সংস্কার কমিশন। ইতোমধ্যে কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে পুলিশ অধ্যাদেশ-২০২৫ বাস্তবায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

সংস্কারের অংশ হিসাবে পুলিশ, র‌্যাব ও আনসারের পোশাক বদলের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুলিশের জন্য আয়রন (লোহার), র‌্যাবের অলিভ (জলপাই) এবং আনসার বাহিনীর জন্য সোনালি গমের (গোল্ডেন হুইট) রঙের পোশাক নির্ধারিত হয়। তাদের মধ্যে পুলিশের পোশাক বদল কার্যকর হয়েছে। র‌্যাব ও আনসারের (শুধু অঙ্গীভূত আনসার) পোশাক বদল বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম