প্রাণী প্রেমের সাক্ষী যে হাসপাতাল
ম্যাক্সের জন্য মনিবের অফুরান ভালোবাসা
মানুষ বেইমানি করতে এক সেকেন্ড সময় নেয় না, কিন্তু পোষা প্রাণী মনিবের জন্য জীবন দিতে দ্বিধা করে না
প্রতীকী ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ম্যাক্স। রক্তক্ষরণে যার জীবন সংকটাপন্ন। আছে আইসিইউতে। চিকিৎসকদের নিরন্তর চেষ্টা চলছে। বাইরে অপেক্ষমাণ অভিভাবক। প্রিয় ম্যাক্সের সুস্থতার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের প্রার্থনা। কিন্তু আইসিইউ থেকে ম্যাক্স আর বের হয় না। এভাবেই কেটে যায় ৫ দিন। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে। উন্নত চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠা ম্যাক্স যেন নতুন করে জীবন ফিরে পায়।
পাঠক, এই ম্যাক্স সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ নয়, একটি পোষা প্রাণী। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান প্রজাতির কুকুর। যাকে সন্তানের মতোই লালন-পালন করেন এক ব্যবসায়ী দম্পতি। সম্প্রতি এক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে গুলশানের একটি প্রাণী চিকিৎসা কেন্দ্রে নেওয়া হয়। বিশেষায়িত হাসপাতালটির নাম ‘প্রিসাইজ পেটল্যাব ডায়াগনস্টিকস অ্যান্ড হসপিটাল।’ শনিবার সরেজমিন হাসপাতালটিতে গেলে পোষা প্রাণীর প্রতি ভালোবাসার এমন আরও অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে।
হাসপাতালটির অন্যতম উদ্যোক্তা সাইদুল নাহিয়ান দীপের কাছে যুগান্তরের প্রশ্ন ছিল যে-সমাজে সাধারণ মানুষ এখনো তার প্রাপ্য চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত, সেখানে পোষা প্রাণীর জন্য এমন অত্যাধুনিক হাসপাতালে কারা আসেন এবং কেনই বা আসেন। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে তিনি বলেন, এক সময় এমন প্রশ্ন আমার মনেও ঘুরপাক খেত। কিন্তু পরে জানতে পারলাম এ সমাজে এমন অনেক হৃদয়বান ব্যক্তি আছেন যাদের কাছে পোষা প্রাণী সন্তানতুল্য। অবলা প্রাণীর মধ্যে তারা এক ধরনের অকৃত্রিম এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসা খুঁজে পান। জীবনের সর্বস্ব দিয়ে বড় করে তোলা সন্তান অনেক সময় পিতামাতাকে ভুলে যায়। প্রয়োজনের সময় তারা পাশে থাকে না। এমনকি খবরও নেয় না। কিন্তু পোষা প্রাণীর ভালোবাসা নিঃস্বার্থ। মনিবের জন্য তারা জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে।
ম্যাক্সের মতোই প্রিয় পোষা বেড়ালের চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে এসেছেন প্রাণী অধিকার কর্মী সারা ফাতেমা। আদর করে বিড়ালটিকে তিনি ‘মম মম’ বলে ডাকেন। চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা নিয়ে চিকিৎসকের কক্ষের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। সারা ফাতেমা বলেন, ও আমাদের পরিবারেরই সদস্য। বলতে পারেন সন্তানের মতো। ওর অসুখ-বিসুখ অথবা ভালো-মন্দে আমরা কেউই স্বাভাবিক থাকতে পারি না।
পেটল্যাবের সব উদ্যোক্তাই পেট প্যারেন্টস। অর্থাৎ সবারই এক বা একাধিক পোষা প্রাণী রয়েছে। এছাড়া প্রাণী নির্যাতন রোধ এবং মালিকবিহীন প্রাণী বা স্ট্রিট অ্যানিম্যালের অধিকার নিয়েও তারা বেশ সোচ্চার ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
উদ্যোক্তারা জানান, রাজধানীতে এখন অনেকেই এক বা একাধিক প্রাণী লালন-পালন করেন। বিড়াল এবং কুকুর ছাড়াও কেউ কেউ খরগোশ, গিনিপিগ এবং পাখি পোষেন। কিন্তু এদের অসুখ-বিসুখে মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়া কঠিন। বিদ্যমান এমন অনিশ্চয়তা থেকেই নির্ভরযোগ্য একটি উন্নত প্রাণী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন তারা।
উদ্যোক্তারা জানান, নিজেদের পোষা প্রাণীর উন্নত চিকিৎসা করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা থেকেই তাদের হাসপাতাল স্থাপনের চিন্তা মাথায় আসে। এরপর উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জাম, আইসিইউ, ২৪ ঘণ্টা হাসপাতাল খোলা রাখাসহ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে বড় বাধা আসে স্থান সংকুলান করতে গিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরেক প্রাণী অধিকার কর্মীর সহায়তায় সে বাধাও দূর হয়ে যায়।
হাসপাতালটি ঘুরে দেখা যায়, দুটি অংশে ভাগ করে সেবা দেওয়া হচ্ছে। একদিকে প্রাণীদের সাজসজ্জার জন্য আধুনিক মেকওভার সেলুন। অন্য পাশের অংশজুড়ে হাসপাতাল। সেখানে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সজ্জিত অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ এবং সিসিইউ। ২৪ ঘণ্টা ইমারজেন্সি সেবা ছাড়াও দ্রুততম সময়ে সেবা পৌঁছে দিতে চালু আছে বিশেষ হটলাইন নম্বর।
উদ্যোক্তাদের দাবি, হাসপাতালে অন্তত ১৫ জন ভেটেরিনারি সার্জন আছেন। এছাড়া অন্যান্য সেবায় নিয়োজিত প্রায় সব কর্মী উন্নত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। নিরবচ্ছিন্ন ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিতে হাসপাতালেই ফার্মেসি সেবা চালু করা হয়েছে। এছাড়া সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তারা স্ট্রিট অ্যানিম্যাল রেসকিউ, পুনর্বাসন এবং প্রয়োজনী চিকিৎসা দিচ্ছেন।
পেট ল্যাবের প্রধান ভেটেরিনারি চিকিৎসক এরশাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দেশে পোষা প্রাণীর মধ্যে সাধারণত কুকুর এবং বিড়ালের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে বিড়ালের অসুখ-বিসুখ বেশি হয়। সাধারণত ফ্লু ভাইরাসে ঘন ঘন আক্রান্ত হয়। সন্তানতুল্য পোষা প্রাণী কোনো কারণে মারা গেলে অনেকে গভীর শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তবে সঠিক চিকিৎসা পেলে কুকুর, বেড়ালসহ অন্য পোষা প্রাণীগুলো সম্পূর্ণ সুস্থ ও সবলভাবে দীর্ঘ সময় বাঁচতে পারে।

