Logo
Logo
×

শেষ পাতা

সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূল

২০ কিলোমিটারজুড়ে বালুখেকোদের রাজত্ব

যুবদল-ছাত্রদলকে যুক্ত করে যুবলীগের সিন্ডিকেট * ব্লক ইজারা নিয়ে বিপদে বৈধরা

Icon

চট্টগ্রাম ব্যুরো

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

২০ কিলোমিটারজুড়ে বালুখেকোদের রাজত্ব

ফাইল ছবি

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সমুদ্র উপকূলের অন্তত ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বালুখেকোদের রাজত্ব চলছে। অবৈধভাবে ২৫ থেকে ৩০টি ড্রেজার লাগিয়ে তারা সলিমপুর থেকে বাড়বকুণ্ড পর্যন্ত এলাকায় দিন-রাত বালু উত্তোলন করছে। একসময় এককভাবে যুবলীগের চিহ্নিত লোকজন এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন যুবদল-ছাত্রদলের কতিপয় নেতাকে যুক্ত করে সিন্ডিকেটকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। নয়ন, রাজিব, সেলিম, আনিস টিটু, নুরুদ্দিন, শাহাদাৎ, সাদ্দামসহ ৮-১০ জনের পৃথক সিন্ডিকেট রয়েছে। এভাবে বালু উত্তোলনের কারণে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা।

চট্টগ্রাম বন্দরকে রাজস্ব দিয়ে সমুদ্রের ব্লক ইজারা নিয়েও কাজ করতে পারছেন না ইজারাদাররা। সিন্ডিকেটের কাছে তারা অসহায়। চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার মো. ওবায়দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলনের অভিযোগ আমরা পেয়েছি। মঙ্গলবারও আমরা অভিযান চালিয়েছি। বেশ কয়েকটি ড্রেজারের কাগজপত্র নিয়ে এসেছি। মালিককে আসতে বলেছি। তবে অনেক সময় খবর লিকআউট হওয়ার কারণে অবৈধ ড্রেজার সরিয়ে নেওয়া হয়। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

দুই মাস আগে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সীতাকুণ্ড উপকূলে চারটি ব্লকের ইজারা বিজ্ঞপ্তি আহ্বান করে। এর মধ্যে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে তিনটি ব্লক ইজারা দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি পায় মেজর (অব.) মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মেসার্স কনস্ট্রা এইড লিমিটেড। একটি ইজারা পায় মোহাম্মদ রায়হান উদ্দিনের মালিকানাধীন এআর ট্রেডার্স। এছাড়া রাইজিং স্টার ও শামা এন্টারপ্রাইজের নামেও দুটি ব্লক অনুমোদন রয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ এই দুটি অনুমোদন দেয় ফেরিঘাটের নাব্য রক্ষা বা সংস্কার কাজের অংশ হিসাবে ড্রেজিংয়ের জন্য। আর বন্দর বালু উত্তোলন ও আহরণের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অনুমোদন দেয়। বিআইডব্লিউটিএ’র অনুমোদন বাণিজ্যিক নয়। তারা ড্রেজিং বা সংস্কার কাজ করলেও বালু বিক্রি করার সুযোগ নেই।

মেজর (অব.) সালাহ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, তিনি ভ্যাট-ট্যাক্সসহ একটি ব্লকের ইজারা নিতে সরকারকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা রাজস্ব দিয়েছেন। ইতোমধ্যে তার ২ থেকে আড়াই কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। এক বছরের জন্য ব্লকের ইজারা পাওয়ার পর দেড় মাস চলে গেছে। কিন্তু তিনি ড্রেজার বসাতে পারছেন না। বালুখেকো সিন্ডিকেট তার ইজারাপ্রাপ্ত ব্লক ও এর আশপাশে বেশ কিছু ড্রেজার বসিয়ে দিনে-রাতে বালু তুলে নিয়ে যাচ্ছে। একই ধরনের অভিযোগ করেন আরেক ইজারাদার রায়হান উদ্দিন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে প্রাপ্ত ব্লকে ড্রেজার বসিয়েছি। কিন্তু বালু তুলতে পারছি না। অবস্থা এমন হয়েছে যে, মাফিয়া সিন্ডিকেটের কাছে আমরা অসহায়। সরকারকে রাজস্ব দিয়েও কাজ করতে পারছি না।’

দুই ইজারাদার জানান, তারা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হাইড্রোগ্রাফি বিভাগে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। অভিযান পরিচালনা করছে-করবে বলেই মাসের পর মাস কাটিয়ে দিচ্ছে বন্দর। কিন্তু কার্যকর কিছুই করছে না। এছাড়া নৌ-পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন বালুখেকোদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

সূত্র জানায়, বালু সিন্ডিকেটের সদস্য জগলুল হোসেন নয়ন একসময় যুবলীগ নেতা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। আর মোহাম্মদ রশিদ ওরফে রাজিব ছিলেন যুবলীগ নেতা। তিনি কুমিল্লা উপজেলা যুবলীগের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে এই দুজন সীতাকুণ্ড উপকূলে অবৈধ বালুর ব্যবসা করে আসছেন। বর্তমানে এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন সীতাকুণ্ড উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কাজী সেলিম উদ্দিন। নুরুদ্দিন, আনিস টিটু, আখতার ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সংগঠনে তাদের পদ-পদবি রয়েছে বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের বালুখেকোরা স্থানীয় যুবদল-ছাত্রদলের কতিপয় নেতা এবং প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বালু ব্যবসার রাজত্ব বহাল রেখেছেন।

জানতে চাইলে জগলুল হোসেন নয়ন যুগান্তরকে বলেন, ‘উপকূলে যারা বালু তোলেন কেউই সম্পূর্ণ বৈধ নন। আবার সম্পূর্ণ অবৈধও নন। আমি ইজারাদার রাইজিং স্টারের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করছি।’

আরেক সদস্য রাজিব বলেন, আমাকে সবাই ‘বালু রাজিব’ হিসাবে ডাকে। এতে কিছু আসে যায় না। যুবলীগের রাজনীতি করার কথাও স্বীকার করেন তিনি। বলেন, আগে ব্যবসা করলেও ৫ আগস্টের পর আর ব্যবসা করছি না। সীতাকুণ্ডে তার কোনো ব্যবসা নেই। এ ব্যাপারে সীতাকুণ্ড উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কাজী সেলিম জানান তিনি বিআইডব্লিউটিএ’র অনুমোদনপ্রাপ্ত একজন ইজারাদারের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন। অবৈধ বালু উত্তোলনের জন্য তিনি রাজিবকে দায়ী করেন। তবে রাজিব দায়ী করছেন সেলিমকে। অবৈধ বালু ব্যবসার বিষয়ে জানতে চাইলে সীতাকুণ্ড আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্ত নেতা কাজী সালাহউদ্দিন বলেন, ‘যারা অবৈধভাবে ব্যবসা করছেন, তাদের কোনো দল নেই। প্রশাসন ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ব্যবহার করে তারা যে কোনো সরকারের আমলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখে। সীতাকুণ্ডেও তাই হচ্ছে। তবে সুযোগ পেলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করব।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম