Logo
Logo
×

শেষ পাতা

পর্যটকদের হাতছানি দেয় বিরিশিরি

নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি রক্ষায় কালচারাল একাডেমি

Icon

তোবারক হোসেন খোকন, দুর্গাপুর (নেত্রকোনা)

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি রক্ষায় কালচারাল একাডেমি

নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি

বিরিশিরি নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম, যা এর মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। এর প্রধান আকর্ষণ হলো বিজয়পুরের চীনামাটির পাহাড় ও তার কোলঘেঁষে তৈরি হওয়া নীল পানির হ্রদ। চীনামাটির পাহাড়ের সাদা মাটি এবং হ্রদের নীলচে-সবুজ পানির সংমিশ্রণ এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি করে। এছাড়া রয়েছে পাহাড় থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরী নদী, যার কাচের মতো স্বচ্ছ পানি পর্যটকদের কাছে টানে। বর্ষাকালে এই নদীর সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে যায়। বিরিশিরিতে ১৯৭৭ সালে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি স্থানীয় উপজাতীয়দের সংস্কৃতিচর্চা ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এখানে একটি জাদুঘরও রয়েছে।

বিরিশিরির ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মূল্যবান ও আকর্ষণীয় সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে মেঘালয় কন্যা সোমেশ্বরী নদীর তীরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে এই একাডেমি। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যসচেতনতা সৃষ্টি এবং জাতিগত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ ও ভাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা। বাংলাদেশের অন্যতম নৃগোষ্ঠী গারো, হাজং, কোচ, বানাই ও ডালু সম্প্রদায়। বৃহত্তর ময়মনসিংহের অন্যান্য জেলার মতো নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে তাদের বসবাস। এই জনগোষ্ঠী শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সময়ের আবর্তে তাদের সাংস্কৃতিক জগতে কিছুটা পরিবর্তন ঘটলেও তা এখনো অনেক সমৃদ্ধ, বৈচিত্র্যময় ও মনোমুগ্ধকর। সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব, অতিথি আপ্যায়নের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে নেই তারা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এগুলো ধরে রেখেছে দুর্গাপুরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি। প্রতিবছরই এখানে অনুষ্ঠিত হয় গারো সম্প্রদায়ের ওয়ানগালা, হাজং সম্প্রদায়ের দেউলী ও বিহু উৎসব। এ উৎসব বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে এক মিলনমেলায় পরিণত হয়।

গারো-হাজংদের সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে সবার প্রথম এগিয়ে আসেন বিরিশিরি এলাকার এক উচ্চশিক্ষিত নারী প্রয়াত বিভা সাংমা। তিনি পরিচালক পদে যোগদানের পর জীবনের শেষ সময়টুকুও বিলিয়ে দিয়েছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি রক্ষার কাজে। পরে বিশিষ্ট কবি রফিক আজাদ ১৯৯৬ সালে এই একাডেমিতে পরিচালক হিসাবে যোগদান করে আদিবাসী সংস্কৃতির পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া বাংলা গান, বাউল গান, পালাগান, বিচার গানসহ কবিগানের মতো উচ্চপর্যায়ের গান সংরক্ষণে কাজ করেন। উদ্ধার করেন বেশ কিছু উপজাতীয় রেঁ রেঁ গানের স্তবক। পরে ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কবি ও গীতিকার সুজন হাজং যোগদানের পর গারো, হাজং, কোচ, বানাই ও ডালু সম্প্রদায়ের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। উপজাতীয় শিল্পীদের গহনা, অত্যাধুনিক বাদ্যযন্ত্র, ব্যবহৃত অস্ত্র, বস্ত্র-পরিচ্ছদসহ কুটিরশিল্পের প্রচুর আসবাবপত্র সংগ্রহ করে সমৃদ্ধ করেন আদিবাসী জাদুঘর। সেই সঙ্গে গবেষণা ও সাংস্কৃতিক শাখাকে উন্নত করে বাংলা সংস্কৃতিতে এনেছেন নান্দনিকতা। উপজাতীয়দের নৃত্য, সংগীত, অভিনয়সহ অভিনয় শিল্পী ও যন্ত্রবাদকদের জন্য প্রশিক্ষণ, সাধারণ ও লোকনৃত্যসহ নজরুল ও রবীন্দ্রসংগীত এবং আধুনিক গানের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে উপজাতীয় তথা বাংলা সংস্কৃতিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন।

এই একাডেমির গবেষণা শাখাকে সমৃদ্ধ করতে আদিবাসীদের ওপর লিখিত বইসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রায় ৫ হাজার মূল্যবান পুস্তক সংগ্রহ করা হয়েছে। জ্ঞানপিপাসুরা এই লাইব্রেরিতে এসে লেখাপড়া ও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করছেন প্রতিনিয়ত। এছাড়া সুসজ্জিত করা হয়েছে একাডেমির জাদুঘর, রেস্ট হাউজ, অডিটোরিয়াম, আদিবাসী শিল্পীদের পোশাক এবং আশপাশের খালি জায়গায় করা হয়েছে ফুলের বাগান।

যারা প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটাতে এবং দেখতে চান আদিবাসীদের নৃত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, তারা বেড়াতে আসতে পারেন নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরের বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমিতে। এখানে নদী ও পাহাড় যেন এক হয়ে মিশে আছে। শত শত নারী-পুরুষ সোমেশ্বরী নদীর বুক থেকে বালু ও কয়লা উত্তোলন করছেন। ঐতিহাসিক কমল রানীর দিঘি যা এখানে এলেই দেখা যাবে। এছাড়া রানীখং মিশন, হাজং মাতা রাশিমণি ও টঙ্ক স্মৃতিসৌধ, কমরেড মণি সিংহ স্মৃতি জাদুঘর, সাদা মাটি এলাকার নীল পানি যেন ভ্রমণপিপাসুদের হাতছানি দিচ্ছে।

একাডেমির পরিচালক কবি পরাগ রিছিল যুগান্তরকে বলেন, প্রতিটি জাতিরই রয়েছে নিজ নিজ সংস্কৃতি। আর ওই সংস্কৃতির মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায় তাদের ঐতিহ্য। আমি অল্প কিছুদিন হলো একাডেমিতে যোগদান করেছি। এরপর থেকে এই এলাকার আদিবাসী সংস্কৃতি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আমার দায়িত্ববোধ থেকে এই অঞ্চলে বসবাসকারী সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নসহ তাদের সংস্কৃতি রক্ষার পাশাপাশি বাংলা সংস্কৃতি নিয়েও কাজ করব। এসব কাজে সহায়তা করতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তরুণ পরিচালক পরাগ রিছিল।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম