জেনেভা ক্যাম্পে অস্ত্র-বোমার ঝনঝনানি
তিন গডফাদারের আস্তানায় ককটেল বানায় ৩০ জন
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঢাকার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প বহুদিন ধরেই মাদক ব্যবসায়ী ও অপরাধীদের অভয়ারণ্য হিসাবে আলোচনায়। তবে সম্প্রতি ক্যাম্পের ভেতরে যা চলছে, তা এলাকাবাসীকে আরও আতঙ্কিত করে তুলছে। এই ক্যাম্পের ভেতরে তিন মাদক গডফাদারের সাতটি গোপন আস্তানায় নিয়মিত তৈরি হচ্ছে ককটেলসহ বিভিন্ন ধরনের হাতবোমা। এই কাজে সক্রিয় রয়েছে অন্তত ৩০ জন কারিগর। যারা রাত নামলেই গোপন আস্তানায় বোমা বানানোর কাজে যোগ দেয়। এসব ককটেল ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘাতে ব্যবহার হয়। পাশাপাশি বাইরেও বিক্রি করা হয়। শুধু তাই নয়, ক্যাম্পে মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে থানা থেকে লুট করা অস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ অস্ত্র। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান ও স্থানীয় একাধিক সূত্রের বরাতে এসব তথ্য জানা গেছে।
জেনেভা ক্যাম্পের ১, ২, ৪, ৭ ও ৮ নম্বর সেক্টরে শীর্ষ তিন মাদক সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে সাতটি আস্তানায় প্রতি রাতেই চলে ককটেল (বিস্ফোরক) তৈরির কাজ। শীর্ষ মাদক সম্রাট বুনিয়া সোহেলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১২ জন বোমার কারিগর। তারা ক্যাম্পের সাত নম্বর ও চার নম্বর সেক্টরের তিনটি আস্তানায় বসে রাতে ককটেলসহ বিভিন্ন ধরনের হাতবোমা তৈরি করে। আরেক মাদক সম্রাট চুয়া সেলিম গ্রুপে বোমার কারিগর রয়েছে ১০ জন। তারা চার ও আট নম্বর সেক্টরে দুটি গোপন আস্তানায় বসে ককটেল তৈরি করে। আরেক মাদক সম্রাট পিচ্চি রাজার অধীনে রয়েছে আটজন বোমার কারিগর। তারা এক ও দুই নম্বর সেক্টরের দুটি গোপন আস্তানায় বসে ককটেল তৈরি করে। ক্যাম্পের খুপড়ি ঘরগুলোকে এরা ককটেল তৈরির নিরাপদ স্থান হিসাবে ব্যবহার করে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে গ্রেফতার এড়াতে এরা ঘন ঘন আস্তানা বদল করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ককটেলের কারিগররা তিন থেকে চারজন করে এক একটি গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজ করে। রাতে এসব আস্তানায় দরজা বন্ধ করে শুরু হয় ককটেল তৈরির কাজ। পুরান ঢাকা থেকে আনা হয় ককটেল তৈরির উপকরণ। গান পাউডার, তারকাঁটা, ছোট ছোট স্পিন্টার ও মার্বেল দিয়ে জর্দার কৌটায় কৌশলে ভরে তৈরি করা হয় শক্তিশালী ককটেল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নম্বর সেক্টরের এক দোকানি যুগান্তরকে বলেন, রাত ১০টার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ক্যাম্পে ককটেল বানানোর কাজ চলে। সাত নম্বর সেক্টরের এক বাসিন্দা জানান, যেসব স্থানে ককটেল বানানো হয়, এর আশপাশে বারুদের (গান পাউডার) গন্ধে বোঝা যায় ওখানে কিছু একটা হচ্ছে। কখনো কখনো ছোটখাটো বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া যায়।
বোমার কারিগর যারা : মাদক সম্রাট বুনিয়া সোহেলের বোমা তৈরির ১২ কারিগরের মধ্যে অন্যতম হলো-কালো, আকরাম, পান্ডা হিরা, রানা, আরিফ, আজম, ফয়সাল, এলেক্স সাজ্জাদ ওরফে গোলাপী, পিচ্চি সামির, হিরোঞ্চি ফারুক, দাগী রুবেল। আরেক মাদক সম্রাট চুয়া সেলিমের ১০ কারিগরের মধ্যে অন্যতম হলো-উল্টা সালাম, সনু, কসাই সোহেল, গালকাটা মনু, কালা ইমরান, বাবু, কালা নবাব, তারেক, পারমনু ও ফরিদ। মাদক সম্রাট পিচ্চি রাজার ককটেল তৈরির দুটি আস্তানায় কাজ করে রিয়াজ, শিশু, শুভ ও মান্নান, মুক্তা রুবেল, পোপলা মুন্না, রনি ও লালন। মান্নান এলাকায় পিচ্চি রাজার ক্যাশিয়ার হিসাবেও পরিচিত।
গত ১৪ নভেম্বর গোপন সূত্রে খবর পেয়ে জেনেভা ক্যাম্পের সাত নম্বর সেক্টরের একটি তিনতলা বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। এসময় ওই বাড়ির নিচতলায় একটি ঘরে ককটেল তৈরির চার বস্তা সরঞ্জাম উদ্ধার করে। পরে দোতলার একটি ঘরে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি তাজা ককটেল এবং পাশেই একটি নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় আরো কয়েকটিসহ ৩৫টি ককটেল। এর আগে যৌথ বাহিনীর একটি দল পিচ্চি রাজার আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ৩২টি ককটেল, ককটেল তৈরির বিপুল কাঁচামাল জব্দ করে। গ্রেফতার করে পিচ্চি রাজার তিন কারিগরকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, স্থানীয় কিছু কারিগর ও বাইরের কিছু কারিগরের সহায়তায় এসব ককটেল তৈরি করা হয়। নিজেদের মধ্যে মারামারির পাশাপাশি বাইরে নাশকতার কাজে এসব ককটেল সরবরাহ করা হয়। এছাড়া একেকটি ককটেল দেড় থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে এমন তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে। সাম্প্রতিক সময়ে ককটেল হামলায় জাহিদ নামে এক যুবক নিহত হন। এরই ভিত্তিতে জেনেভা ক্যাম্পে নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে।
ক্যাম্পে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি : শুধু ককটেল নয়, জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে মজুত রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র-এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। জুলাই আন্দোলনের সময় ও পরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে লুট হওয়া কিছু অস্ত্র ক্যাম্পে ঢুকেছে। এরপর থেকে ক্যাম্পে রক্তক্ষয়ী আধিপত্যের লড়াইয়ে ১৮ মাসে নিহত হন ১০ জন। আহত হন বহু মানুষ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সূত্র জানায়, আন্দোলনের সময় ২০২৪ সালের জুলাইয়ে স্থানীয় এমপি জাহাঙ্গীর কবির নানকের পিএস বিপ্লব, ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাস্টন ও যুবলীগ নেতা রাজীব ক্যাম্পের ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ ও যুবলীগপন্থি মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে ৪৫টি আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেন। এসব অস্ত্র তখন ব্যবহারও করা হয়। আ.লীগ সরকার পতনের পর অস্ত্রগুলো ক্যাম্পেই রয়ে গেছে। ৫ আগস্ট রাতে মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলানগর থানায় লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সেই বিশৃঙ্খলার সুযোগে ক্যাম্পের সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিরা লুট করে আরও বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র।
অভিযান চালিয়ে পুলিশ সর্বমোট পাঁচটি অস্ত্র উদ্ধার করেছে, যার দুটি পাওয়া যায় পরিত্যক্ত অবস্থায়, একটি সৈদপুরিয়া গ্রুপের বাসা থেকে এবং দুটি বুনিয়া সোহেলের ভাই টুনটুনের কাছ থেকে। এছাড়া মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে রয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে কিনে আনা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে আরও ভয়ংকরভাবে অস্ত্রের জোগান বাড়ায় বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, পিচ্চি রাজা, শাহ আলম ও মনু গ্রুপ। তারা অবৈধভাবে আরও ৮ থেকে ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা।
অভিযোগ রয়েছে ৭ নম্বর সেক্টরের চোটি নাদিম, বুনিয়া সোহেলের ঘনিষ্ঠ। সে তার শ্বশুরবাড়ি মিরপুর ১১ নম্বর মিল্লাত ক্যাম্প থেকে অর্থের বিনিময়ে বুনিয়া সোহেলকে অস্ত্র এনে দিয়েছে। অন্যদিকে শাহ আলমের মামা শরীফ, ’৯০-এর দশকের কুখ্যাত ক্যাডার, তার মাধ্যমেও অস্ত্র ঢুকেছে ক্যাম্পে।
এসব বিষয়ে বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম ও পিচ্চি রাজার ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল ভয়াবহ ভিডিও : সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক সংঘর্ষের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা গেছে চাইনিজ অস্ত্র, শটগান, পাইপগানসহ নানা আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ক্যাম্পের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের হাতে।
বুনিয়া সোহেল গ্রুপের কলিম জাম্বু, গোলাম নাসিম, টুনটুন, দাগী রুবেল, তানভীর, ফুল্লা সাহিদের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে। চুয়া সেলিম গ্রুপের চুয়া সেলিম নিজে, কিলার আকরামকে প্রকাশ্যে গুলি চালাতে দেখা গেছে। এ ছাড়া পিচ্চি রাজা, পিচ্চি শামির, পার মনু, শাহ আলম, ইমতিয়াজসহ আরও অনেককে সংঘর্ষে বোমা নিক্ষেপ করতে দেখা গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, জেনেভা ক্যাম্প এখন আর বসতির জায়গা নয়। দিনরাত ভয় কখন আবার গুলি শুরু হয়।
অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক মনে করেন, ক্যাম্পের মাদক ও অপরাধ কমাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে। নতুবা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। ক্যাম্পে অস্ত্রের অবাধ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ না হলে যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। এছাড়া বোমার কারিগরদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান বলেন, জেনেভা ক্যাম্পকে অন্যতম অপরাধ জোন হিসাবে বিবেচনায় রেখে অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে। যেকোনো মূল্যে ক্যাম্পের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে। অপরাধীদের প্রতিনিয়ত আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

