আগুনে ছাই কড়াইল বস্তি
খোলা আকাশের নিচে নিঃস্বদের আহাজারি
চোখের সামনে আগুনে সহায়-সম্বল ছাই হওয়ায় কান্না থামছে না রাজধানীর মহাখালীর কড়াইল বস্তিবাসীর। বুধবার তোলা -যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কড়াইল বৌবাজার বস্তির আগুন নিভে গেছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের বুকের ভেতরে এখনো আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। মঙ্গলবার বিকালের হঠাৎ লাগা আগুনে পুড়ে গেছে বস্তির দেড় হাজারের বেশি ঘর। পুড়েছে দোকান, রিকশার গ্যারেজ, সেলাই মেশিন, বই-খাতা, কাপড়-চোপড়সহ সাংসারে ব্যবহারের জিনিসপত্র। যারা সন্তানদের নিয়ে হাসি-আনন্দের ঘর সাজিয়েছিলেন, তারা এখন দাঁড়িয়ে আছেন ধ্বংসস্তূপের ওপর। এভাবে স্বপ্ন ছাই হয়ে যাবে- এটা কেউ কল্পনা করতে পারেননি। এই আগুন শুধু ঘর ছাই করেনি, ছাই করেছে রাত-দিন পরিশ্রম করে জমানো বহু বছরের সঞ্চয় আর ভবিষ্যতের ভরসা। এখন তাদের সামনে পোড়া মাটি, ছাই, আর অনিশ্চিত আগামী।
মঙ্গলবার বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে লাগা আগুন ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে ১৬ ঘণ্টা পর বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় সম্পূর্ণ নেভাতে সক্ষম হয়। আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। কমিটি ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে।
বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা শুধু খোলা আকাশে নিচে অবস্থান করছেন না। তারা খাবার ও পানি সংকটে আছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে খাবার ও পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে এটা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
বুধবার ভোরে সরেজমিনে দেখা যায়, পোড়া ধ্বংসস্তূপে কেউ খুঁজছেন হাঁড়ি, কেউ খুঁজছেন বউয়ের গহনা, কেউ সন্তানদের স্কুলের বই। কিন্তু কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। মঙ্গলবার বিকালেও যাদের ঘর ছিল, ঘরে খাবার ছিল, রাত নামতেই তারা হয়ে যান গৃহহীন। এখন খাবার পানিটুকু নেই। ধ্বংসস্তূপের পাশেই শিশু-কিশোররা বসে আছে বিমর্ষ হয়ে। ৫০ বছর বয়সি আলেয়া বেগম ছাইয়ের ওপর বসে আছেন স্তব্ধ হয়ে। বারবার বলছেন, ‘সব গেল, তিনবার আগুনে পুড়লাম, এবার আর কিছুই রইল না।’
আলেয়া বেগমের স্বামী নেই। দুই ছেলেকে মানুষ করতে যে দোকানটি গড়ে তুলেছিলেন, সেটিও ছাই। আগুনের সঙ্গে পালাতে গিয়ে শুধু একটি ব্যাগ নিয়ে বের হতে পেরেছিলেন। ব্যাগে ছিল চিকিৎসার কাগজ আর একটি পুরোনো শাড়ি। এখন থাকার জায়গা নেই।
একই অবস্থা সালেমা খাতুনের। তিন সন্তান নিয়ে রাত কাটিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে। ঠান্ডায় ছোট সন্তান কাঁপছিল। সালেমার চোখে রাজ্যের শোক।
বস্তির বাসিন্দা জমির হোসেন বলেন, ‘সরকারি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। তদন্তের ফল যাই আসুক, হারানো ঘর, হারানো স্মৃতি আর কি ফিরে আসবে বস্তির মানুষরা জানেন, আগুন নিভে গেছে ঠিকই কিন্তু তাদের জীবনের অনিশ্চয়তার আগুন আরও অনেকদিন জ্বলতেই থাকবে।
শেরপুরের রূপচান মিয়া (৫০)। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ঢাকায় আসেন ৪ মাস আগে। এরপর বস্তির শুক্কুরের বাড়িতে একটি রুম ভাড়া নেন। স্ত্রী বনানীর একটি বাসায় ঝিয়ের কাজ করেন। আর রূপচান নিজে মাটি কাটার কাজ করেন। বড় ছেলে মৃণাল একটি গার্মেন্টে কাজ করছে। রূপচান পোড়া ভিটেতে ৪ বছর বয়সি মেয়ে রুখসানাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। জানান, পরনের কাপড় ছাড়া আর অবশিষ্ট কিছু নেই।
বরিশালের উজিরপুরের আব্দুল কালাম (৫৫)। ২৯ বছর আগে ঢাকায় এসে এই বস্তিতে ঠাঁই নেন। তার তিন রুমের ঘরটি পুড়ে গেছে। ছেলে সবুজ ঢাকা পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা করেছে। তার সব সার্টিফিকেট এবং এনআইডি পুড়ে গেছে। আবুল কালাম বলেন, ‘এ নিয়ে তিনবার আগুনে সর্বস্ব হারালাম।’
বস্তির বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন। পেশায় ভ্যানচালক। পুড়ে গেছে তার ঘর। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে তিনি খোলা আকাশের নিচে। মমতাজ (৩৫) কাজ করেন বনানীর একটি বাসায়। দুই ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন কড়াইলে। আগুনে মুহূর্তেই সব হারিয়ে এখন দিশেহারা।
এই বস্তির তালতলায় ওয়াসা পাম্পসংলগ্ন স্থানে ‘মায়ের দোয়া বিদ্যানিকেতন ও হাই স্কুল নামে’ স্কুলটিও পুড়ে গেছে। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া।
বাস্তির বাসিন্দা মুরশিদ মিয়া জানান, গুদারাঘাটের কবরস্থান রোডের মিন্টু মিয়ার বাড়ির রান্নাঘরের গ্যাস সিলিন্ডারের পাইপ ছিদ্র হয়ে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আরেক ব্যবসায়ী রাসেল মিয়াও একই কথা জানান। তবে এ বিষয় জানতে মিন্টু মিয়ার বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মেয়ে শিউলি জানান, আগুনের পর থেকে আমার মা নিখোঁজ। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা (মিন্টু মিয়া) মাকে খোঁজায় ব্যস্ত। শিউলি বলেন, আগুনে আমাদের ২০টি ঘর পুড়েছে। এর আগেও দুবার বস্তিতে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হই। এই নিয়ে তিনবার হলাম। প্রথমবার ২০০৪ সালে। দ্বিতীয় বার ২০১৭ সালে।
বস্তির বাসিন্দা মনিরা আক্তার নিকেতনে বাসাবাড়িতে কাজ করেন। তার স্বামী রিকশাচালক। এই বস্তিতে ১৮ বছর ধরে থাকেন। তিল তিল করে ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেছেন। কিন্তু আগুন সব শেষ করে দিয়েছে। মনিরা বলেন, ঘরে নগদ ৪৫ হাজার টাকা ছিল। সব পুড়ে গেছে।
বস্তিবাসীর জন্য খাবার ও চিকিৎসা সেবা : বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। বুধবার সকালে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন এবং ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কড়াইল বস্তিতে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। এ সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ওষুধও দেওয়া হয়। বেসরকারি সংস্থা আলো ক্লিনিকের উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে চিকিৎসা এবং ওষুধ-পথ্য সরবরাহ করা হয়। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও বস্তিতে মেডিকেল ক্যাম্প করতে দেখা গেছে। সকালে দলটির পক্ষ থেকে খাবার সরবরাহ করা হয়। দুপুরে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থর পক্ষ থেকে ৪ হাজার মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়।
দুপুরে পুড়ে যাওয়া বস্তি পরিদর্শনে যান বাম গণতান্ত্রিক জোটের একটি প্রতিনিধিদল। বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখেন এবং অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধসহ ত্রাণ সাহায্যের পাশাপাশি তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়া তদন্তপূর্বক অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদ্ঘাটন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তারা।

