বিতর্কিত বক্তব্য ও বেফাঁস মন্তব্য
আলোচনায় জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
আমাকে যারা চিনে না, তারা এখনো মাটির নিচে বসবাস করে * পুলিশ আমাদের কথায় উঠবে, আমাদের কথায় বসবে, আমাদের কথায় গ্রেফতার করবে, আমাদের কথায় মামলা হবে
চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শাহজাহান চৌধুরী
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া আংশিক) আসনের জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ও দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী নানা বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচনি গণসংযোগে তার নানা বিস্ফোরক মন্তব্য ও বক্তব্য প্রতিদিন সামাজিক মাধ্যমেও ভাইরাল হচ্ছে।
কেউ পক্ষে, কেউ তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে করছেন আলোচনা-সমালোচনা। জামায়াতের মজলুম ও কারা নির্যাতিত প্রবীণ নেতা, দুইবারের সাবেক এমপি ও জামায়াতের সংসদীয় দলের হুইপ হিসাবে দায়িত্বপালনকারী এ নেতার সাম্প্রতিক অনেক বক্তব্যকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে। একটি বক্তব্যের জন্য তিনি নিজেও সামাজিক মাধ্যমে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আরেকটি বক্তব্যের জন্য দল থেকে তাকে শো’কজ করা হয়েছে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্যের একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। সাতকানিয়া উপজেলার চরতি ইউনিয়নের তুলাতুলি বাজারে নির্বাচনি গণসংযোগকালে শাহজাহান চৌধুরীকে বলতে শোনা যায়, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে রাজনৈতিক বাড়াবাড়ি করিয়েন না। আমার নাম শাহজাহান চৌধুরী। আমি শুনতেছি, অনেকজনে নাকি আমাকে নিয়ে উলটাপালটা বলতেছে’।
হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ‘খবরদার, খবরদার; আমি শাহজাহান চৌধুরী। আমাকে যারা চিনে না, তারা এখনো মাটির নিচে বসবাস করে। আমি চোখ তুলে দেখতেছি, আমার জন্য আল্লাহ আছে। আল্লাহর মেহেরবানি, আল্লাহ আমার জন্য সূর্য ঠেকিয়ে রাখবেন। আল্লাহ তায়ালা আমাকে এরকম মর্যাদা দিয়েছেন।’
আরেকটি ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস তাকে ‘গার্ডিয়ান অব চিটাগং’ বা চট্টগ্রামের অভিভাবক হিসাবে ঘোষণা করেছেন।
এর আগে ২২ নভেম্বর সন্ধ্যায় নগরীর জিইসি কনভেনশন সেন্টারে জামায়াতের চট্টগ্রামের নির্বাচনি দায়িত্বশীল সমাবেশে শাহজাহান চৌধুরী বলেছিলেন, ‘নির্বাচন শুধু জনগণকে দিয়ে নয়। আমি ন্যাশনালি বলব না, যার যার নির্বাচনি এলাকায় যারা আছে, প্রশাসনে যারা আছে, তাদের অবশ্যই আমাদের আন্ডারে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের কথায় উঠবে, আমাদের কথায় বসবে, আমাদের কথায় গ্রেফতার করবে, আমাদের কথায় মামলা করবে।’
ওই বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ‘যার যার নির্বাচনি এলাকায় প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারকে দাঁড়িপাল্লার কথা বলতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষককে দাঁড়িপাল্লার কথা বলতে হবে। পুলিশকে আপনার পেছনে পেছনে হাঁটতে হবে। ওসি সাহেব আপনার কী প্রোগ্রাম সকাল বেলায় জেনে নেবেন, আর আপনাকে প্রটোকল দেবে।’ একই সভায় তিনি আল্লাহ জামায়াতকে ক্ষমতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এমন বক্তব্যের প্রতিবাদে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন একটি বিবৃতি দিয়েছে। একইসঙ্গে জামায়াতের পক্ষ থেকেও ওই বক্তব্যের জন্য শাহজাহান চৌধুরীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার স্বাক্ষরিত এই নোটিশে শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্যের উদ্ধৃতিগুলো তুলে ধরে বলা হয়, ‘এই বক্তব্য রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের পেশাদারি, নিরপেক্ষতা ও মূল স্পিরিটকে স্পষ্টভাবে ব্যাহত করেছে। আমরা মনে করি, প্রশাসন পূর্ণ পেশাদারির সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করবে, এখানে আমাদের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে আপনি এই ধরনের সাংগঠনিক ভাব-মর্যাদা ক্ষুণ্নকারী ও শৃঙ্খলাবিরোধী বক্তব্য রেখেছেন। যার ফলে আপনাকে কয়েকবার সতর্ক করা হয়েছে ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। জামায়াত আমিরও আপনাকে ডেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং সতর্ক করেছেন। এতদসত্ত্বেও আপনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।’ শোকজের জবাব সন্তোষজনক না হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শৃঙ্খলাবিধি ভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।
এর আগে ৬ মে নগর জামায়াত নগর কার্যালয়ে বালাকোট দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি চট্টগ্রামের ষোলশহরে অবস্থিত এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য রাখেন।
এতে তিনি বলেন, ‘আমাদের জামায়াতের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে যারা মাঠে কাজ করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই। তারা পরিস্থিতি এক ঘণ্টার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আপনি চিন্তা করতে পারেন আনজুমানে রহমানিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসায় সেনাবাহিনী প্রত্যেকটা রুমে রুমে, পুরো সেনাবাহিনী তল্লাশি করেছে। অনেক অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে। ওই অস্ত্রগুলো সব ছাত্রলীগের অস্ত্র। সব আওয়ামী লীগের অস্ত্র। এগুলো সব ওইখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এভাবে মাইজভান্ডার ঘেরাও করা হোক। পটিয়ার আমির ভান্ডার ঘেরাও করা হোক। সেখানেও অস্ত্র পাওয়া যাবে। আমি চট্টগ্রাম মহানগরীরগুলো বললাম না। আমির ভান্ডার মাইজভান্ডার আরও কী কী ভান্ডার আছে ওখানে তল্লাশি চালানো হোক।’
শাহজাহান চৌধুরীর এই বক্তব্য নিয়েও চট্টগ্রামে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয় জামেয়া মাদ্রাসার পক্ষ থেকে। ওই মাদ্রাসায় সেনাবাহিনী কোনো অভিযান চালায়নি এবং কোনো অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি বলে জানানো হয়। মাইজভান্ডার ও আমির ভান্ডার দরবারের ভক্তরাও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়। একপর্যায়ে শাহজাহান চৌধুরী তার ওইসব বক্তব্যের জন্য সামাজিক মাধ্যমে দুঃখ প্রকাশ করেন। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে এসব কথা বলেছেন বলে স্বীকার করেন।
প্রসঙ্গত, শাহজাহান চৌধুরী ১৯৯১ ও ২০০১ সালে চট্টগ্রাম-১৫ (তৎকালীন চট্টগ্রাম-১৪, সাতকানিয়া- লোহাগাড়া) আসন থেকে জামায়াতের প্রার্থী হিসাবে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে জামায়াতের প্রয়াত আমির অধ্যাপক গোলাম আজমকে প্রতিরোধ করতে আসা লোকদের সামনের সারিতে থেকে তিনি নিজেই প্রতিরোধ করেন। ছাত্রশিবিরের নেতা ছিলেন। পরে তিনি ধাপে ধাপে উঠে এসে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের সর্বোচ্চ আমির পদে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিগত ১৬ বছরের মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি সাড়ে ৯ বছর জেল খাটেন। বাকি সময়গুলোতেও নানাভাবে পুলিশি হয়রানির শিকার হন। এসব কারণে শাহজাহান চৌধুরী ‘মজলুম জননেতা’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন।
