Logo
Logo
×

শেষ পাতা

দলিত সমাজের মুক্তির পথপ্রদর্শক হরিচাঁদ ঠাকুর

মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান শ্রীধাম ওড়াকান্দি

Icon

এস এম হুমায়ূন কবীর, গোপালগঞ্জ

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান শ্রীধাম ওড়াকান্দি

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের মন্দির -যুগান্তর

গোপালগঞ্জের শ্রীধাম ওড়াকান্দি হিন্দু ধর্মের মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আন্দোলনের কেন্দ্র। মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রবর্তক পূর্ণব্রহ্মা শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ১৮১২ সালের ১১ মার্চ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি ইউনিয়নের সাফলিডাঙ্গা গ্রামে জম্মগ্রহণ করেন। তিনি যশোবন্ত ঠাকুর ও অন্নপূর্ণা দম্পতির পাঁচ ছেলের মধ্যে দ্বিতীয়। বাল্যকালে তিনি ‘হরি ঠাকুর’ নামে পরিচিত ছিলেন। তবে ভক্তরা তাকে ‘হরিচাঁদ’ নামে ডাকতেন। হরিচাঁদ ঠাকুর পরবর্তীতে সাফলিডাঙ্গা গ্রাম থেকে পার্শ্ববর্তী ওড়াকান্দিতে বসতি স্থাপন করেন। ওই গ্রামেই শুরু হয় তার আধ্যাত্মিক সাধনা-প্রতিষ্ঠিত করেন ‘মতুয়াবাদ’।

হরিচাঁদ ঠাকুর ছিলেন একজন সনাতন ধর্মগুরু। তার প্রবর্তিত ওই মতবাদ ছিল প্রথাগত ধর্মীয় আচার-আচরণ ও জাতিভেদ প্রথার বিরোধী। তার আধ্যাত্মিক সাধনা ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া ও দলিত শ্রেণির মানুষের উন্নয়নে নিবেদিত। মতুয়া শব্দের অর্থ হলো-মত্ত বা মাতোয়ারা হওয়া। অর্থাৎ, যারা হরিপ্রেমে মাতোয়ারা তারাই মতুয়া।

জানা গেছে, ওই সময় সমাজের পিছিয়ে পড়া নিম্নবর্ণের ও দলিত শ্রেণির হিন্দুদের ‘চণ্ডাল’ বলে সম্বোধন করা হতো। সংখ্যার দিক থেকে এরা বেশি হলেও সমাজে ছিল চরম উপেক্ষিত। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচার, নির্যাতন, অবজ্ঞা ও অবহেলার কারণে প্রাপ্ত সম্মান, সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ফলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা সমাজের মূল স্রোত থেকে দূরে সরে যায়। এ সময় তাদের জাগরণে হরিচাঁদ ঠাকুর আবির্ভূত হয়েছিলেন ‘অবতার’ হিসাবে। সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তির লক্ষ্যে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের কঠোর জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তিনি।

হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছিলেন, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য দেব-দেবীর পূজা বা মন্দিরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ঈশ্বরের কাছে সবাই সমান। তার এই বার্তা দলিত হিন্দুদের মনে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে। তারা অনুভব করেন জন্মগতভাবে তারা অস্পৃর্শ্য নয়; বরং ঈশ্বরের কাছে তারা অন্যদের মতোই সমান মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী। দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে সঙ্গে ‘হাতে কাম, মুখে নাম’-অর্থাৎ হরিনাম জপ করাই ছিল মতুয়াবাদের মূলমন্ত্র। সৎ পথে থেকে পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব পালন করার মধ্যদিয়ে ঈশ্বরকে লাভ করার শিক্ষা দেন হরিচাঁদ ঠাকুর। তার মতে, ‘মানব ধর্মই আসল ধর্ম’।

হরিচাঁদ ঠাকুর শুধু একজন আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন না। ব্যবহারিক জীবনেও দলিত শ্রেণির মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করেছেন। তিনি তাদের শিখিয়েছিলেন, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ছাড়া পিছিয়ে পড়া বৃহৎ এ জনগোষ্ঠীর মুক্তি সম্ভব নয়। তাই তিনি তার অনুসারীদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে ও নিয়মিত পরিশ্রম করতে উৎসাহিত করতেন। তার এ শিক্ষা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে শক্তি সঞ্চার করে। দ্রুত তার এ মতবাদ জনপ্রিয়তা পায়। দিন দিন বাড়তে থাকে মতুয়া ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা। ফলে মতুয়াবাদ এক সময় মতুয়া ধর্ম নামে পরিচিতি লাভ করে।

১৮৭৮ সালে হরিচাঁদ ঠাকুর ইহধাম ত্যাগ করেন। এরপর মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন তার ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুর। বাবার আদর্শকে সামনে রেখে মতুয়া আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যান তিনি। তার নেতৃত্বে মতুয়া আন্দোলন ধর্মীয় আন্দোলনের পাশাপাশি একটি সামাজিক আন্দোলনেও রূপ নেয়।

গুরুচাঁদ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন, শিক্ষাই হলো পিছিয়ে পড়া মানুষের মুক্তির প্রধান উপায়। তিনি নিরক্ষরতা দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ওই সময় গুরুচাঁদ ঠাকুরের একটি উক্তি নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে তা হলো-‘প্রয়োজনে ভিক্ষা করে লেখাপড়া কর’। শিক্ষা বিস্তারে তিনি ঢাকা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও যশোরে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘অরিত্র বিদ্যালয়’ ছিল অন্যতম। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নমঃশূদ্রদের প্রবেশাধিকার না থাকায় ওইসব বিদ্যালয় তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে সাহায্য করে।

ব্রিটিশ সরকারের কাছে নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য সরকারি চাকরিতে তিনি কোটা সংরক্ষণের দাবি জানান। তার আন্দোলনের ফলে শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে নমঃশূদ্রদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা চালু হয়। তিনি কৃষকদের অধিকার আন্দোলনে সব সময় সামনের সারিতে ছিলেন। তেভাগা আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম একজন দিকনির্দেশক।

প্রতিবছর হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে বার্ষিক মতুয়া মহোৎসব ও বারুণী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ মতুয়া ভক্ত ও অনুসারী সমবেত হয় তাদের ধর্মগুরুর পবিত্র স্থানে। ওই দিন ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, রোগ মুক্তি ও মনের বাসনা পূরণে প্রার্থনা এবং কামনা সাগর ও দুধ সাগরে পূণ্যস্নান করে নির্মল হন ভক্তরা।

সরেজমিন দেখা যায়, কালের পরিক্রমায় শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে গড়ে ওঠেছে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এর মধ্যে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রধান তীর্থস্থান ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ি, হরিচাঁদ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত বসতবাড়ি, হরিচাঁদ ও তার ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামে নির্মিত মন্দির ও ঠাকুরবাড়ির পাশে চণ্ডী মন্দিরসহ আরও কিছু ছোট ছোট মন্দির রয়েছে। ভক্তদের পুণ্যস্নানের জন্য রয়েছে কামনা সাগর ও দুধ সাগর নামে দুটি পুকুর। প্রতিবছর চৈত্র মাসের মধুকুঞ্জা ত্রয়োদশী তিথিতে হরিচাঁদ ঠাকুরের জম্মতিথি উপলক্ষ্যে বারুণী স্নানোৎসবে কামনা সাগর ও দুধ সাগরে পুণ্যস্নান করে মতুয়া ভক্তরা। এ উপলক্ষ্যে ঠাকুরবাড়িতে বসে বারুণী মেলা। এছাড়াও, ওড়াকান্দিতে রয়েছে একটি জাদুঘর। যেখানে মতুয়া সম্প্রদায়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হয়। মতুয়াবাদের প্রচারণা ও প্রসারের জন্য ওড়াকান্দিতে প্রকাশনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ঠাকুরবাড়িতে স্থাপন করা হয় একটি প্রিন্টিং প্রেস। ‘মতুয়া দর্পণ’ নামে পত্রিকা ছাপা হতো ওই প্রেসে। পত্রিকাটি পরবর্তীতে মতুয়া সম্প্রদায়ের মুখপত্র হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।

ওড়াকান্দি মেলা উদযাপন কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মতুয়া ভক্ত অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, বর্তমানে দেশ-বিদেশে মতুয়া সম্প্রদায়ের অন্তত পাঁচ কোটি ভক্ত ও অনুসারী রয়েছেন। এর মধ্যে সিংহভাগ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন। পশ্চিমবঙ্গে তিন কোটির বেশি মতুয়া অনুসারী রয়েছেন। এছাড়া আন্দামান দীপপুঞ্জ, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ত্রিপুরা, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলংকায় রয়েছে মতুয়া সম্প্রদায়ের বসবাস।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম