গঙ্গাচড়ায় খুনের মামলা
ঘুস না পেয়ে মা ও বোনকে আসামি করল পুলিশ
মাহবুব রহমান, রংপুর
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রংপুরের গঙ্গাচড়া মডেল থানার মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার চাওয়া ঘুসের আড়াই লাখ টাকা দিতে রাজি হননি জামাতা। তাই সম্বন্ধীর খুনের মামলায় আসামি করা হলো স্ত্রী ও শাশুড়িকে, অর্থাৎ খুনের দায়ে কারাগারে আটক আসামির মা ও বোন। এ ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি। ঘুসের টাকা দাবি করার অডিও কল রেকর্ড যুগান্তরের হাতে এসেছে।
এর সূত্র ধরে সরেজমিন অনুসন্ধানে গঙ্গাচড়া মডেল থানায় করা জিআর-১৮৩/২০২৪ মামলার বর্ণনায় জানা যায়, এই থানার মণ্ডলের হাট গ্রামের বাসিন্দা মাদকাসক্ত মাহাবুব হাসান বল্টু (৪০) পরকীয়ার অভিযোগ এনে স্ত্রী শুকতারা বেগমকে (৩৫) হত্যা করেন। গত বছরের ৪ জুন রাতে দুজনের বাগবিতণ্ডার পর স্বামী বল্টু স্ত্রীকে শ্বাসরোধ ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেন।
খুনের ঘটনার সময় বল্টুর মা আশরেফা সরকার (৫৮) নাতি মাসুক হাসান সরকার অপূর্বকে (১৪) নিয়ে মেয়ে মৌসুমি আক্তার মিতুর বাড়িতে ছিলেন। খুনের পর বল্টু বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। পরের দিন বাড়ি ফিরলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এরপর ৬ জুন ২০২৫ তিনি রংপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হাসিনুর রহমান মিলনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
স্বীকারোক্তিতে মাহাবুব হাসান বল্টু বলেন, ‘আলামিন নামে এক ছেলের সঙ্গে স্ত্রী শুকতারা বেগম পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে। ঘটনার রাতে আমার মা, বোন ও ছেলে রংপুর নগরীতে ছোট বোনের শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। আমরা স্বামী-স্ত্রী বাড়িতে ছিলাম। গভীর রাতে আমি স্ত্রীকে দেখি আলামিনের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছে। এ নিয়ে আমাদের দুজনের বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে আমি নেশাগ্রস্ত থাকায় স্ত্রীর গলা চেপে ধরি। পরে দেখি সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। তখন ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যাই। পরের দিন পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে।’
মামলাটির দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন গঙ্গাচড়া মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর উত্তম কুমার রায়। তিনি কারাগারে আটক বল্টুর ছোট বোনের স্বামী চঞ্চল মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর তাকে প্রস্তাব দেন পুলিশের এসপি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ওসিকে টাকা না দিলে মামলায় তার স্ত্রী ও শাশুড়িতে আসামি করা হবে। মামলার এজাহারে নাম থাকলেও তদন্ত করে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তাই এই মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ আছে। সে কারণে ৩ লাখ টাকা দাবি করেন তিনি।
ভুক্তভোগী পরিবারের জামাতা চঞ্চল মাহমুদ তদন্ত কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়ের মোবাইল ফোনে ১৯ জুলাই রাত ১০টা ১১ মিনিটে কথা বলেন। ওই কথোপকথনে শোনা যায়, বল্টুর মা ও ছোট বোন অর্থাৎ চঞ্চল মাহমুদের শাশুড়ি ও স্ত্রীকে চার্জশিটে নাম না দেওয়ার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা উত্তম কুমার তিন লাখ টাকা চাইছেন। চঞ্চল মাহমুদ এতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, এটা আমার সামর্থ্যরে বাইরে, দয়া করেন ভাই। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, এখানে আমার একার সিদ্ধান্তে কিছু হয় না। বড় মামলার ব্যাপারে সবার চোখ থাকে। এরপর চঞ্চল মাহমুদ এক লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, তারা তো আসলে দোষী না। পুলিশ কর্মকর্তা তখন বলেন, ‘দোষী নয় বলেই টাকা দিতে হবে। দোষী হলে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ পরে তিনি আড়াই লাখ টাকা দিতে বলেন। নইলে পরদিনই চার্জশিট দিয়ে দেবেন বলে জানান।
মামলার সাক্ষী খোরশেদ আলম বলেন, তাকে মামলার সাক্ষী হিসাবে দেখানো হলেও তিনি পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি। তাকে দিনমজুর দেখানো হলেও তিনি আলমবিদিতর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হিসাবে ১৫ বছর ধরে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। মামলার অপর সাক্ষী আনিছুর রহমান, মনমোহন রায় মন্টু, বিউটি বেগম, রুপালী বেগম ও লিপি আক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এই মামলায় পুলিশের কাছে কোনো সাক্ষী বা জবানবন্দি দেননি। তবুও তাদের সাক্ষী হিসাবে বক্তব্য চার্জশিটে লেখা হয়েছে।
এ নিয়ে রংপুর পুলিশ সুপার আবু সাইমের সঙ্গে দেখা করে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে কথা বললেও তিনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। সর্বশেষ তিনি জানিয়েছেন, অভিযোগ দিলে তিনি বিষয়টি দেখবেন। গঙ্গাচড়া মডেল থানার ওসি আল এমরানের কাছে এই ঘুসের টাকা দাবি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার নিজস্ব বিষয়। তবে থানার ওসি হিসাবে আমি বলতে পারি, এখানে কেউ বাণিজ্যে জড়িত হলে তার শাস্তি হবে।
