বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস আজ
দৃষ্টিহীনদের দিশা দেখাতে বার্ডোর নিরন্তর সংগ্রাম
ব্লাইন্ড এডুকেশন অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশনের একটি ক্লাসরুমে মঙ্গলবার পরীক্ষা দিচ্ছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা -যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ছেলেবেলায় টাইফয়েডে দৃষ্টি হারিয়েছিলেন। কিন্তু হারাননি মনোবল। জ্ঞানান্বেষণের তৃষ্ণায় নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অন্য আর দশজনের মতোই শিক্ষিত নাগরিকের মর্যাদা আদায় করে নেন। জীবনে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন। তবে তিনি কেবল নিজের কথা ভাবেননি। দেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জীবনে সুখের আলো ফোটাতে গড়ে তোলেন ব্লাইন্ড এডুকেশন অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (বার্ডো)। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক দায়িত্ব নেন একুশে পদকপ্রাপ্ত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মো. সাইদুল হক নিজেই। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি অনেক প্রতিবন্ধীর জীবনের আলো ফিরিয়ে দিয়েছেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষার আলো দিয়ে গড়ে তুলছেন সুনাগরিক হিসাবে। করছেন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও। বার্ডোর হাসপাতালে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কম করচে চিকিৎসার ব্যবস্থাও রয়েছে।
রাজধানীর মিরপুরে বার্ডোর অফিসে গিয়ে দেখা গেল, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা ব্রেইল পদ্ধতিতে দিচ্ছেন বার্ষিক পরীক্ষা। কিছু শিক্ষার্থী ব্রেইল লাইব্রেরিতে পড়াশোনায় মশগুল। অফিসের নিচেই রয়েছে ব্রেইল বই ছাপার ব্যবস্থা। ট্রেনিং সেন্টারে কম্পিউটারে বসে প্রশিক্ষণে ব্যস্ত অনেক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী।
বার্ডোর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে সাইদুল হক যুগান্তরকে বলেন, আমি যখন পড়াশোনা শুরু করি, তখন দেখলাম দেশে ব্রেইল বই নেই। নেই শিক্ষকও। তৃতীয় বাধা দেখলাম প্রতিবন্ধীদের কোনো চাকরি নেই। এভাবে দেখতে দেখতেই মনে হলো এই কমিউনিটির জন্য কাজ করা দরকার। এই নাই নাইয়ের মধ্যেই আমি এসএসসি, এইচএসসি পাশ করলাম। অনার্স ও মাস্টার্স করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর মনে হলো একটি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করানো দরকার। অর্থাৎ প্রতিবন্ধী মানুষদের সমাজের মূল স্রোতধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করাই ১৯৯১ সালের ১৭ জুলাই। উদ্দেশ্য, প্রতিবন্ধী মানুষকে ক্ষমতায়ন করা, তাদের কর্মসংস্থান যাতে মসৃণ হয় সে চেষ্টা করা।
বার্ডোর পথচলা ও সংগ্রামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি চিন্তা সব সময় মাথায় ছিল যে ভাড়া বাড়িতে কিছু করা যাবে না। যদিও ভাড়া বাড়িতেই যাত্রা শুরু, ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির অফিসে। সেখানে প্রয়াত শাফায়াত আহমেদ চৌধুরী আমাদের একটি রুম দিলেন। টেবিল-চেয়ার দিলেন কাজ শুরু করতে। তারপর বিভিন্ন ডোনার এজেন্সি ও মানুষ আসা শুরু করল। অনেকে অফিসের ভেতরে অফিস পছন্দ করলেন না। তাই পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে চলে এলাম শ্যামলীর ভাড়া বাড়িতে। সেখানে প্রায় ১০ বছর আমরা কার্যক্রম চালিয়েছি। তারপর ২০০৩ এ মিরপুরের রূপনগরে চলে আসি। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ থেকে নির্ধারিত দামে জমি ক্রয় করেছি। প্রথম ও দ্বিতীয় তলা নির্মাণ করে দিয়েছিল জাপান দূতাবাস। তৃতীয় তলা করে দেয় ঢাকা জেলা পরিষদ। চারতলা নির্মাণ করতে সহযোগিতা করে ইন্ডিয়ান হাইকমিশন। পাঁচতলা ও ছয়তলা নির্মাণ করে দেয় রহিম স্টিল। ব্রেইল বই ছাপানোর জন্য প্রেস দিয়েছে জাপান দূতাবাস। কম্পিউটারগুলোও দান করেছে অনেকেই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের দু-একটি খ্যাতনামা আই হসপিটালে যেখানে অপারেশন খরচ হয় এক থেকে দেড় লাখ টাকা, সেখানে আমরা এখানে অপারেশন করছি ৫০ হাজার টাকায়। আমরা চাই অপেক্ষাকৃত কম দামে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ যেন সেবা পায়। এখানে পাঁচজন ডাক্তার আছেন। সার্জন আছেন দুইজন। নার্স আছেন ৬ জন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেদের জন্য বিদ্যালয়ে আছে ৬০টি আসন। বিনামূল্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিশোররা শিক্ষা পাচ্ছে। কিছু শিশু বাসা থেকে আসে। তবে ৪০ জনের মতো এখানেই বসবাস করে। চারতলায় ওদের জন্য ৬০টি বিছানা আছে। স্কুলটি চলে মানুষের অনুদানে। স্কুলের জন্য একটি ফান্ড তৈরির চেষ্টা চলছে। সরকারের কাছ থেকে স্কুলের শিক্ষকদের জন্য বেতন আনার চেষ্টা করছি। এখানে যে কোনো প্রতিবন্ধী কেনোরকম ফি ছাড়াই নানা ট্রেনিং নিতে পারে। অন্যদের ট্রেনিং নিতে ন্যূনতম একটি ফি দিতে হয়। বেইল লাইব্রেরিটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য। কোনো সার্কুলার হলেই আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে প্রতিবন্ধীদের জন্য চাকরি দিতে অনুরোধ করি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে চাকরি দিয়েছি। এছাড়া ১৫টি জেলায় কার্যক্রম আছে। প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে দল গঠন করেছি। প্রতিটি দলে ১০-১৫ জন সদস্য আছেন। তারা ট্রেনিং, কর্মসংস্থান পেতে কাজ করে।
কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যবসা করতে চাইলে ব্যাংকের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দিই। ব্যাংক টাকা দিতে না চাইলে আমরা গ্যারান্টি দিই।
সফলতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এখন শতভাগ ব্রেইল বই দিচ্ছে সরকার। এটি বড় সফলতা। দ্বিতীয়ত সফলতা হলো আমরা বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারতাম না। কিন্তু এখন সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারেন। তৃতীয়ত, আমরা যখন লেখাপড়া করি, তখন কোনো আইন ছিল না। এখন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুরক্ষা আইন হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি, তখন তা প্রতিবন্ধীবান্ধব ছিল না। ভর্তি হওয়ার পর আমি অন্যান্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে মিটিং করেছি। তারপর কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও কিছু কাজ করেছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা এখন সহজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। ৭০-৮০ জন প্রতিবন্ধী ভর্তি হতে পেরেছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা স্পেশাল স্কলারশিপ পাচ্ছেন রেজিস্টার বিল্ডিং থেকে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কোনো ছাত্র বা ছাত্রী এমফিল করতে চাইলে আগে সে সুযোগ ছিল না। এখন সুযোগ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) লাইব্রেরিতে কর্নার চেয়েছিলাম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য, হয়েছে। ঢাবিতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ৩-৪ জন মানুষ কাজ করছেন সফলতার সঙ্গে। তিনি বলেন, বার্ডো থেকে আমরা আইসিটি মন্ত্রণালয়ে অধীনে ২০০ প্রতিবন্ধীকে ট্রেইনিং দিয়েছি ৮টি বিভাগীয় শহরে। ৫টি কোর্সে অ্যাডভান্স লেভেলে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সাড়ে সাত হাজার নারীকে ট্রেনিং দিয়েছি।
বার্ডোর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে সাইদুল হক বলেন, আমরা চাই দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে বার্ডোর শাখা থাকুক। যেখানে একটি ট্রেনিং সেন্টার, একটি হাসপাতাল ও কাউন্সেলিং সেন্টার থাকবে। মানুষ যেন এসে পরামর্শ নিতে পারে। আমরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্য আবাসিক হোস্টেল করতে চাই। টেকনিক্যাল ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার করতে চাই, যেখানে সব ধরনের প্রতিবন্ধী ট্রেনিং নেবে। এখানে সরকারের সহযোগিতা দরকার। স্কুলটি সরিয়ে মানিকগঞ্জে বড় জায়গায় নির্মাণ করা হবে। এজন্য সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নিতে হবে। আলাদা মন্ত্রণালয় করতে হবে তাদের জন্য। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা ন্যূনতম ৫ হাজার টাকা দেওয়া উচিত। ৯০০ টাকা ভাতা এ বাজারে খুবই কম।

