Logo
Logo
×

শেষ পাতা

গৌরবময় মহান মুক্তিযুদ্ধ

সত্যিকারের সাম্যের দেশ দেখে বিদায় নিতে চাই

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ পাতান

Icon

তোজাম্মেল আযম, মেহেরপুর

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সত্যিকারের সাম্যের দেশ দেখে বিদায় নিতে চাই

আবদুল মজিদ পাতান

মেহেরপুর জেলা শহরের ফুলবাগানপাড়ার মল্লিক ভিলায় বসে আছেন বয়োবৃদ্ধ আবদুল মজিদ পাতান, মুক্তিযুদ্ধের আগুনঝরা দিনগুলোর সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকা এক লড়াকু যোদ্ধা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরীর, তবুও একাত্তরের মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা মনে হলে চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। ডান কাঁধে এখনো রয়েছে পাক বাহিনীর ছোড়া গুলির দাগ, যা তাকে প্রতিদিন স্মরণ করিয়ে দেয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা। তবে তার চেয়েও গভীর ক্ষত-স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও দেশে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রবীণ এই যোদ্ধা শেষ বয়সে শুধু একটি আশাই বুকের ভেতর লালন করছেন-সত্যিকারের সাম্যের দেশ দেখে বিদায় নিতে চান।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ পাতান বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে দেওয়া সাহস এবং ২৬ মার্চ বেতারে মেজর জিয়াউর রহমানের সেই ডাক আমাকে যুদ্ধে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু আজও দেখি বৈষম্য, দুঃশাসন আর অন্যায় আমাদের সমাজকে পেয়ে বসেছে। এমন দেশ তো আমরা চাইনি।

মুক্তিযোদ্ধা মজিদ একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি। পেশায় শহরের বড় বাজার ব্যবসায়ী সমিতির অফিস সহায়ক।

স্মৃতির পাতা উলটে মজিদ বলেন, ১৯৬৬ সালে আনসার বাহিনীতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। তখন থেকেই মনে ছিল দেশের জন্য কিছু করার তীব্র তাগিদ। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে মেহেরপুর জেলা তথ্য অফিস থেকে মাইকে উচ্চারণ হয় উদ্বেগজনক বার্তা-পাকিস্তানি সেনারা চারদিক থেকে শহর ঘিরে ফেলেছে। সবাইকে যার যা আছে তা নিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলা হয়। আমি তখন বাড়ি থেকে বের হলাম হাতে শুধু একটি লাঠি। বড়বাজার মোড়ে আবুল হোসেনসহ আরও কয়েকজন স্থানীয় যুবকের সঙ্গে দেখা হয়। সেখান থেকে আমরা ছুটে যাই মেহেরপুর কোর্টে। জেলা আনসার অ্যাডজুটেন্ট আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও পাঁচ রাউন্ড করে গুলি দেন। এই অস্ত্রই ছিল আমাদের প্রথম শক্তি।

মজিদ বলেন, তার নেতৃত্বাধীন ছয়জনকে পাঠানো হয় সদর উপজেলার গোপালপুর ব্রিজ এলাকায়। সেখানে একটি প্রাকৃতিক পরিখার পাশে তারা অবস্থান নেন। ২৮ মার্চ সকাল পর্যন্ত সেখানে থেকেই নজরদারি চালান। পরে তাদের ফিরিয়ে আনা হয় মেহেরপুর শহরে। সেদিনই তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কুষ্টিয়ার মিরপুরে। সেখান থেকে হেঁটে যান মশান, পরে ত্রিমোহনীর চেয়ারম্যান বাড়িতে। ২৯ মার্চ সকালে কয়েকজনকে পাঠানো হয় বিভিন্ন এলাকায় রেকি (গোপন পর্যবেক্ষণ) মিশনে। এরই মধ্যে চুয়াডাঙ্গা থেকে ইপিআরের উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী বড় একটি দল নিয়ে সেখানে পৌঁছান। রেকি দল ফিরে এসে পুলিশলাইন, ওয়্যারলেস অফিস ও জেলা স্কুলে পাক বাহিনীর ঘাঁটির নকশা তুলে দেয়। প্রথমে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও শেষ পর্যন্ত মেজর চৌধুরী তিনটি দলে বিভাজনের মাধ্যমে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।

মজিদ বলেন, ৩০ মার্চ ভোর। চারদিক থেকে ঘিরে পুলিশ লাইনে গুলিবর্ষণ শুরু করি আমরা মুক্তিযোদ্ধারা। পালটা হামলায় পাক বাহিনীও তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল এমন যে পাকসেনারা ঠিকমতো টার্গেট করতে পারেনি। এ সময় মেহেরপুরের তরুণ যোদ্ধা ফজলুর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

অবস্থানের একটি নির্দেশ স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হন মজিদ। ‘কালাচাঁদপুরের হাবিলদার মসলেম আমাকে বলেছিলেন, পেছনের একটি জায়গায় গিয়ে পজিশন নিতে। সেখান থেকে গুলি করলে শত্রুপক্ষ বুঝতে পারবে না। তার নির্দেশেই আবার ফায়ারিং শুরু করেছিলাম। যুদ্ধের একপর্যায়ে আমার ডান কাঁধে গুলি লাগে। প্রথমে বুঝতে পারেননি যে সেটা বুলেট। পরে রক্ত দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফেরে কুষ্টিয়া হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ৮ এপ্রিল আমাকে পাঠানো হয় মেহেরপুর হাসপাতালে।’

তিনি জানান, সেদিন প্রায় সব পাকিস্তানি সেনাই মারা যায়। যারা পালায়, তারা ঝিনাইদহের দিকে সরে যায়। পরে ১৪ এপ্রিল বিমান হামলা করে আবার কুষ্টিয়া দখলে নেয় তারা। তার আহত হওয়ার এবং কুষ্টিয়া যুদ্ধের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশ বাণী কলকাতা থেকে প্রচার হয়। যা মুক্তিযুদ্ধে তাকে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করে।

কুষ্টিয়া পুলিশলাইনে যুদ্ধরত অবস্থায় তিনি ১২/১৩ বছরের এক কিশোরের কাছ থেকে পান এক গ্লাস পানি ও একটি রুটি। তিনি বলেন, বিশ্বাস অর্জনের জন্য আমি প্রথমে তাকে খাইয়ে নিয়েছিলাম। পরে কিশোরটি আমাকে এক প্যাকেট গুলি দেয়। যুদ্ধের ভেতর এমন মানবতার দৃষ্টান্ত আমি জীবনে ভুলব না।

গুলি লাগার পর ভারতের করিমপুরে আত্মীয়দের বাড়িতে দীর্ঘ সময় চিকিৎসা নেন তিনি। মাঝে মাঝে যান টেহট্ট থানার বেতাই যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর নিতে। ৬ ডিসেম্বর তিনি ফিরে আসেন মেহেরপুরে।

যুদ্ধের বীরত্বগাথা বলতে গিয়ে তার চোখে জল এসে জমে। তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ করেছি সমান অধিকার, ন্যায়বিচার আর শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য। কিন্তু আজ দেখি দুর্নীতি বেড়েছে, বৈষম্য বেড়েছে, ন্যায়বিচার পেতে মানুষের কাঁদতে হয়। স্বাধীনতার সোনালি ফসল আমরা পুরোপুরি পাইনি। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যে সম্মানি পাই তাতে রাজার হালে সংসার চলে। কিন্তু যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ ছিল তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।

তার কণ্ঠে আক্ষেপ, মৃত্যুর আগে শুধু একটি জিনিস দেখতে চাই-একটি সাম্যের বাংলাদেশ।

প্রতিবেশী, স্বজন ও স্থানীয় মানুষদের অনেকেই মনে করেন, এমন একজন মুক্তিযোদ্ধার শেষ বয়সে রাষ্ট্রীয় সম্মান, সামাজিক নিরাপত্তা ও মানসিক সহায়তা আরও বেশি প্রাপ্য।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম