প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা
তীব্র নিন্দা প্রতিবাদ বিভিন্ন সংগঠনের
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ এবং নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। এসব সংগঠনের নেতারা পৃথক বিবৃতিতে বলেন, সংবাদপত্র ও সিনিয়র সাংবাদিকের ওপর এ ধরনের হামলা নজিরবিহীন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার শামিল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর হামলা মুক্ত গণমাধ্যম, ভিন্নমত ও বাকস্বাধীনতার ওপর হামলা।
এদিকে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ পৃথক বিবৃতিতে বলেছে, এ হামলার ঘটনা দেশের গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার ওপর স্পষ্ট হামলা এবং দিনটি ‘কালো দিন’ হিসাবে গণ্য হবে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তারা।
বৃহস্পতিবার রাতে জুলাই আন্দোলনের অকুতোভয় নেতা ওসমান হাদির মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর কাওরান বাজারে প্রথম আলো ও ফার্মগেটে ডেইলি স্টারের কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়। হামলাকারীরা পত্রিকা দুটির অফিস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ডেইলি স্টারের অফিস ও ভবনটি। এ ঘটনার পর দুটি পত্রিকা শুক্রবার প্রকাশ হয়নি। অনলাইনও বন্ধ ছিল। আজ শনিবার থেকে প্রথম আলো প্রকাশ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার বিকালে পত্রিকা দুটির অনলাইন পুনরায় চালু হয়। এদিকে একই সময়ে সিনিয়র সাংবাদিক নূরুল কবীরের ওপরও হামলা করা হয়।
ডেইলি স্টারের একজন সাংবাদিক যুগান্তরকে জানিয়েছেন, অফিসের অবস্থা ভয়াবহ। পুরো অফিসে কিছুই নেই। হয় পুড়ে গেছে নতুবা লুট করা হয়েছে। এ অবস্থায় বিশেষ ব্যবস্থায় পত্রিকা বের করার চেষ্টা চলছে। শুক্রবার দুপুরে প্রথম আলো অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, পত্রিকা ভবনটি পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে। বিকাল তিনটার পর সিআইডির টিম এসে আগুন দেওয়া এবং লুটপাটের ঘটনার আলামত সংগ্রহ করেছে। অফিসের নিচে প্রথম আলোর কর্মীরা উদ্বিগ্ন হয়ে অবস্থান করছেন। বিকাল চারটার দিকে গণমাধ্যমের ওপর হামলার প্রতিবাদে প্রথম আলোর আক্রান্ত ভবনের সামনে এক মানবন্ধনের অয়োজন করা হয়। সেই কর্মসূচিতে পত্রিকাটির সম্পাদক মতিউর রহমানসহ বিভিন্ন পেশার নেতারা অংশ নেন। মানববন্ধন কর্মসূচিতে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর হামলা সংবাদমাধ্যম, বাকস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের জন্য কালো দিন। বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা, ভিন্নমতের প্রকাশ ও সংবাদপত্রের ওপর কঠিন আক্রমণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রথম আলো প্রকাশের পর গত ২৭ বছরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য রওনক হোসেন, বিএফইউজের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী, ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম, ডিআরইউ নেতা মেহেদী আজাদ মাসুমসহ বিভিন্ন পেশাজীবী নেতা অংশ নেন মানববন্ধনে।
প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদক বলেন, এ ধরনের হামলা খুবই আতঙ্কজনক ও উদ্বেগের। এভাবে কেউ কখনো হামলা করবে, তা আমরা চিন্তাও করিনি। ওই হামলার ঘটনা নিয়ে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ এক বক্তব্যে বলেছে, বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলো অফিসে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। দীর্ঘ সময়ের এই আগুনে ভবন, সংরক্ষিত সম্পদ ও মূল্যবান নথি পুড়ে গেছে। এর আগে আক্রমণের আশঙ্কায় নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা আসার আগেই অফিস আক্রান্ত হয় এবং উদ্বিগ্ন কর্মীরা জীবন বাঁচাতে অফিস ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।
শুক্রবার বিকালে ডেইলি স্টার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, অফিসের নিচে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা পাহারা দিচ্ছেন। অনেক কর্মী নিচে পায়চারি করছেন। তারা অফিসে হামলা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ডেইলি স্টারের একজন কর্মী যুগান্তরকে বলেন, অফিসে কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। এমনকি পিসি, ক্যামেরাসহ সব কিছু নিয়ে গেছে। ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ তাদের এবং প্রথম আলোর ওপর হামলার ঘটনাকে দেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর হামলা বলে উল্লেখ করেছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পত্রিকা দুটিকে বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার হুমকি দেওয়া হলেও সরকার এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।
টিআইবির উদ্বেগ : শরিফ ওসমান বিন হাদি হত্যাকাণ্ডে গভীর উদ্বেগ ও এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একইসঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মুক্ত গণমাধ্যম, ভিন্নমত ও বাকস্বাধীনতার ওপর সংঘটিত আক্রমণ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তি, নাগরিক নিরাপত্তা, স্বাধীনতার চেতনা এবং জুলাই অভ্যুত্থানের মূল্যবোধের ওপর সরাসরি আঘাত বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, টার্গেটেড শুটিংয়ে জড়িতদের গ্রেফতারে সরকারের ব্যর্থতা, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যেতে সহায়তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গণরোষের ফলে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা ঠেকাতে ব্যর্থ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর ধারাবাহিকতায় প্রথম আলো, ডেইলি স্টার কার্যালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীরের ওপর হামলা, ছায়ানটে হামলা-এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখার সুযোগ নেই। বরং এসবই মুক্তচিন্তা, ভিন্নমত ও স্বাধীন মতপ্রকাশকে পরিকল্পিতভাবে দমনের জ্বলন্ত উদাহরণ।
মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ : শুক্রবার এক বিবৃতিতে মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন (এমএফসি) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক মিশন এক বিবৃতিতে বলেছে, সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব হামলা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও জনগণের জানার অধিকারকে সরাসরি আঘাত করে। সব গণমাধ্যমকর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি।
সিপিজের উদ্বেগ : গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। শুক্রবার এক বিবৃতিতে সিপিজে বলেছে, তারা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি হামলার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনার আহ্বান জানাচ্ছে।
বিএফইউজে ও ডিইউজের নিন্দা-প্রতিবাদ : ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)। শুক্রবার এক বিবৃতিতে বিএফইউজে সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী এবং ডিইউজে সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান। এদিকে ডিইউজের আরেক অংশের সভাপতি সাজ্জাদ আলম খান তপু ও সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন এক বিবৃতিতে ন্যক্কারজনক এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের জেফারসন ফেলোদের বিবৃতি : তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জেফারসন ফেলোরা। শুক্রবার এক যৌথ বিবৃতিতে তারা সারা দেশে চলমান ভাঙচুরের ঘটনাগুলোরও প্রতিবাদ জানান। সেই সঙ্গে ওসমান হাদির হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবিলম্বে স্বাভাবিক করার জোর দাবি জানান। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও জেফারসন ফেলো শাহেদ সিদ্দিকী, আজিজুর রহমান ও ফয়সাল মাহমুদ।
এফইআরবির তীব্র নিন্দা : নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ (এফইআরবি)। শুক্রবার এক বিবৃতিতে সদস্যদের পক্ষে সংগঠনের চেয়ারম্যান মো. শামীম জাহাঙ্গীর ও নির্বাহী পরিচালক সেরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেন, এই ধরনের হামলা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এছাড়া নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব ও দলীয় মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, ডিপ্লোমেটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিক্যাব)। এদিকে হাদির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম।
