Logo
Logo
×

শেষ পাতা

গৌরবময় মহান মুক্তিযুদ্ধ

পিতৃহত্যার বদলা নিতে যুদ্ধে গিয়েছিলেন আবু সালেক

পেয়েছেন বীরপ্রতীক খেতাব

Icon

মো. ফজলে রাব্বি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পিতৃহত্যার বদলা নিতে যুদ্ধে গিয়েছিলেন আবু সালেক

মো. আবু সালেক

বাংলাদেশের খেতাবপ্রাপ্ত সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক মো. আবু সালেক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার ধরখার ইউনিয়নের হাশিমপুরের আবু সালেক ১৯৭১ সালে ছিলেন কসবা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর। পাকিস্তানি হানাদাররা তার বাবা-চাচা এবং চাচাতো ভাইসহ ৩৩ জনকে হত্যা করে। তার মধ্যে টানমান্দাইল গ্রামেরই ২৭ জন। প্রতিশোধের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় আবু সালেক পাঠ্যবই ফেলে সীমানা পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল নিজ এলাকা কসবা থেকে চলে যান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। আখাউড়া উপজেলার হাশিমপুরের ঠিকানায় গিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সেই সময়কার কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেকের। আবু সালেক জানান, যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর তিনি চাচা হামিদুর রহমান ও মামা আব্দুল খালেকের সঙ্গে আগরতলায় চলে যান। সেখানকার ত্রিপুরা প্রদেশ কংগ্রেস ভবনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে লোক বাছাই চলছিল। বাছাইপর্ব শুরু হলে ভারতীয় এক সেনা কর্মকর্তা তাকে দেখে বলেন, এ তো বাচ্চা ছেলে। এ বাচ্চা ছেলেকে যোদ্ধা হিসাবে নির্বাচন করা যাবে না বলে মত দিলেন বাঙালি কর্মকর্তারাও। যুদ্ধে যেতে পারবেন না জেনে সবার সামনেই কেঁদে ফেললেন সালেক। তার কান্নায় অফিসাররা মত পাল্টান। প্রথমে ওমপিনগরে তার প্রশিক্ষণ হয়। এরপর তাকে পাঠানো হয় মেলাঘরে ২ নম্বর সেক্টরে। সেখানে তিনি চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত হন।

আবু সালেক তার বাবা হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে জানান, যুদ্ধের সময় ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহে তার বাবা আব্দুল হাশিম, চাচা আবদুল খালেক, গোলাম কাদের, চাচাতো ভাই তারা মিয়া, সজরুল হকসহ টানমান্দাইল ও জাঙ্গাল গ্রামের ৩৩ জন সাধারণ মানুষকে স্থানীয় গঙ্গাসাগর দীঘিরপাড়ে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। এর আগে তাদের দিয়েই গর্ত খোঁড়ানো হয়। ওই ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে তার বড় ভাই আবুল খায়ের মাস্টার ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। আবুল খায়েরকে মৃত ভাবা হয়েছিল। পরে ভাসতে ভাসতে গঙ্গাসাগর দীঘিরপাড় হয়ে বাড়িতে ফিরেছিলেন তিনি। বাবা, চাচা, চাচাতো ভাইসহ ৩৩ জনকে হত্যার ঘটনায় প্রতিশোধস্পৃহা তৈরি করে আবু সালেকের মনে। আবু সালেক বলেন, ‘আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম বাপ-চাচা ও ভাইদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে।’ যুদ্ধে যাওয়ার পর অবশ্য অনেক বড় একটা স্বপ্ন জন্ম হয়েছিল মনে। সেই স্বপ্ন এখনো অনর্জিতই রয়ে গেছে। তার বাবার হত্যাকারীদের মূল হোতা রাজাকার মোবারকের ফাঁসির আদেশ হয়েছে।

যুদ্ধের সময়ের কথা বলতে গিয়ে আবু সালেক জানান, একদিন হাবিলদার আবদুল হালিমের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা মনিয়ন্দ গ্রামে গিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কয়েকদিন পর তারা ১০ জন রাতে আবার পাকিস্তানি সেনাদের পাকা বাংকারের কাছে গিয়ে অধিনায়কের নির্দেশে গুলি করতে শুরু করেন। একসঙ্গে ১০টি অস্ত্র থেকে ক্রমাগত গুলি চলে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর।

তার ১০ দিন পর আরেকটি অপারেশন করে আবু সালেক ও তার সহযোদ্ধারা কসবা হাইস্কুলের কাছাকাছি চন্দ্রপুরে।

২২ নভেম্বর চন্ডীদ্বারবাজারসংলগ্ন খাতপাড়ায় এক যুদ্ধে আবু সালেক শত্রুপক্ষের নিক্ষিপ্ত শেলের টুকরোর আঘাতে আহত হন। তাকে উদ্ধার করে ভারতের গৌহাটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সুস্থ হয়ে ফেরেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী ছাড়ার পর থেকে সরকারি পাট ক্রয়কেন্দ্রে সাধারণ একজন কর্মচারী হিসাবে চাকরি করেছেন। পাট ক্রয়কেন্দ্রে যোগদানের পর চট্টগ্রামে কাজ করেছেন কিছুদিন। সেখান থেকে বদলি হয়ে পরে চলে যান সিরাজগঞ্জে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সেই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেকের গ্রামের নাম এখন হাশেমপুর। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত আবু সালেকের বাবা শহীদ আবুল হাশেমের নামানুসারে গ্রামটির নামকরণ করা হয় হাশেমপুর। স্থানীয় ধরখার-আখাউড়া সড়কের ধরখার মৌজায় অবস্থিত হাশেমপুর গ্রামটির আগের নাম ছিল ভাঠামাথা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম