Logo
Logo
×

শেষ পাতা

প্রাধান্য পাবে নিরাপত্তা

নতুন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ঠিক করবে নির্বাচিত সরকার

শেখ মামুনুর রশীদ

শেখ মামুনুর রশীদ

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ঠিক করবে নির্বাচিত সরকার

দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কোথায় হবে-সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার ভেতরে অবস্থিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনকে একীভূত করে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বানানোর যে প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে সরে এসেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকরা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত ভবিষ্যৎ সরকারপ্রধানের নিরাপত্তার বিষয়টি আমলে নিয়েই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নতুন বাসভবনের সন্ধানও চলছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এলাকাসহ একাধিক বিকল্প মাথায় রেখেই সাজানো হচ্ছে পরিকল্পনা। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা এবং হেয়ার রোডের ২৪ ও ২৫ নম্বর বাংলোবাড়িকে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন হিসাবে রূপান্তরের বিষয়টি আলোচনায় ছিল। তবে যমুনা ঢাকা শহরের মধ্যবর্তী জায়গায়। হেয়ার রোড থেকে তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দূরত্বও অনেক। এখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর যাওয়া-আসায় যানজট তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। যা নগরবাসীর জন্য চরম দুর্ভোগ ডেকে আনবে। এছাড়া মিন্টো রোডে বাংলো আছে। দুটি প্লট একত্র করেও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন করার বিষয়টি ভাবনায় ছিল। এ ক্ষেত্রেও যানজটের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এরকম একাধিক প্রস্তাব আলোচনায় থাকলেও বাস্তবায়নের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। গণপূর্ত অধিদপ্তরের একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী যুগান্তরকে জানান, একাধিক বিকল্প নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, আগামী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কোথায় হবে, সেটি ঠিক করবে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে আসা নতুন সরকার। বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা দেখভাল করছেন। তারাও এ বিষয়ে একমত হয়েছেন।

জানা গেছে, ৭ জুলাই নতুন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন নির্ধারণের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়। যার নেতৃত্বে রয়েছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম। স্থাপত্য অধিদপ্তর, সংসদ সচিবালয় এবং এসএসএফের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই কমিটিতে আছেন। নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কোথায় হবে, তা নিয়ে ওই কমিটির সদস্যরা কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। প্রথমে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেপ্টেম্বরে কমিটির সদস্যরা ভবন দুটি পরিদর্শনও করেন।

সূত্র জানায়, বাসভবন দুটি একীভূত করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন করতে সংস্কার কাজে কেমন খরচ হতে পারে, তা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। পরিদর্শন কমিটির সদস্যদের মতে, এখন বাড়ি দুটি যে অবস্থায় আছে, তাতে সংস্কারের জন্য অনেক বেশি টাকা প্রয়োজন হবে না। দুটি ভবনের মধ্যে সংযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসংক্রান্ত কিছু কাজ করতে হবে। এর জন্য বেশি সময়ও লাগবে না। আলাদা দুটি ভবনের মধ্যে সহজ যাতায়াতের জন্য একটি দুই স্তরবিশিষ্ট করিডোর নির্মাণ, একই সঙ্গে এ-১ ও এ-২ বাসা দুটিও পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করারও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নিরাপত্তাসহ বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে তারা জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন নির্মাণের উদ্যোগ থেকে শেষ পর্যন্ত সরে আসে।

এ প্রসঙ্গে সংসদ সচিবালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের মতো সংবেদনশীল স্থাপনার জন্য ঢাকা শহরে জুতসই স্থান পাওয়া খুবই মুশকিল। কারণ এক্ষেত্রে একই সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টিও সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। তাই খুব ভেবে ও যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংসদ ভবন এলাকা নিরাপত্তার জন্য কোনোভাবেই জুতসই হবে না। এখন সংসদ অধিবেশন নেই। কিন্তু নির্বাচিত সরকারের সময় দুই মাস পরপর অধিবেশন বসবে। সংসদ অধিবেশনের সময় সংসদ-সদস্যরা ছাড়াও তাদের নির্বাচনি এলাকার লোকজন আসেন। তাদের পরিবার, আত্মীয়স্বজনরাও এখানে থাকেন। সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকেন। তাই সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের জন্য এই জায়গা বেছে নেওয়া ঠিক হবে না-এটা কমিটির সদস্যরাও উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাড়ি দুটিকে একীভূত করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের জন্য নির্ধারণ করা হলে নতুন সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার কোথায় থাকবেন, তা নিয়েও ভাবতে হবে। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের জন্য নতুন বাসভবন খুঁজতে হবে। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত বাড়িতে তিনি থাকলেই শুধু হবে না, তার দপ্তরসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিরাপত্তায় নিয়োজিতরা কোথায় থাকবেন, সে প্রশ্নও ওঠে। তাদের জন্যও নতুন করে বাড়ি বানাতে হবে। সংসদ ভবন এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর জন্য বাসভবন ও তার দপ্তরসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের জন্য বাড়ি তৈরি করা হলে বিখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের নকশার লঙ্ঘন হবে।

জাতীয় সংসদ ভবনের পশ্চিম পাশে (আসাদগেটের দিকে) স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের জন্য নির্ধারিত বাসভবন অবস্থিত। পাশাপাশি দক্ষিণমুখী লাল ইটের ভবন দুটি দোতলা, একই আদলে তৈরি। সামনে খোলা জায়গা ও বাগান আছে। চারদিকে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। যদিও জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা নিয়ে তৈরি করা স্থপতি লুই আই কানের নকশায় এ দুটি বাসভবন ছিল না। ২০০২ সালে তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ভবন দুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। লুই আই কানের নকশা অনুসরণ না করার অভিযোগ তুলে সেখানে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের আবাসিক ভবন নির্মাণের বৈধতা নিয়ে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ হাইকোর্টে রিট করে। ২০০৪ সালের ২১ জুন সংসদ ভবন এলাকায় স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। পরে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল ঘোষণা করেন।

সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক (টুকু) এ দুটি বাসভবনে ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বাসভবন দুটি ফাঁকা রয়েছে। সাবেক স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এখনো লাপাত্তা। তবে সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক (টুকু) হত্যাসহ একাধিক মামলায় কারাগারে আটক রয়েছেন।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর জন্য বাসভবন নির্মাণ করতে হলে এ সংক্রান্ত প্রকল্প গ্রহণ করতে হয়। এই প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বা সংসদ সচিবালয়কে। প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দ থাকতে হবে। বরাদ্দ নিশ্চিত করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সরকারের নেওয়া মূল এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) এ ধরনের কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। অন্যদিকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য নেওয়া এডিপিতেও এ ধরনের কোনো প্রকল্প পাওয়া যায়নি। আবার জাতীয় সংসদ সচিবালয় থেকে নেওয়া ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপিতেও এ সংক্রান্ত কোনো প্রকল্প নেই। ফলে আপাতত সংসদ ভবন এলাকা কিংবা অন্য কোথাও আগামী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর জন্য নতুন বাসভবন নির্মাণের কাজ শুরু হচ্ছে না।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছিল গণভবন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। সেদিন বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবনে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এর এক মাস পর গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে গণভবনকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত হয়। পিলখানা হত্যাকাণ্ড, গুম-খুন-আয়নাঘর, ভোট ডাকাতিসহ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনামলের সব ঘটনাই ঐতিহাসিক তথ্য হিসাবে এই জাদুঘরে উপস্থাপন করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তখনকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে গণভবন নির্মাণ করা হয়। তবে তিনি গণভবনে বসবাস করেননি। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৫ সালে গণভবনকে সংস্কার করে এটিকে ‘করতোয়া’ নাম দিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। তখন তিনি গণভবন নাম পুনর্বহাল করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন হিসাবে সেখানে বসবাস করেন। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কখনো গণভবনে থাকেননি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর গণভবন আবার সংস্কার করা হয়। ২০১০ সালের মার্চে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার এখানে উঠেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের দুপুর পর্যন্ত তিনি এই ভবনে ছিলেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম