Logo
Logo
×

শেষ পাতা

কৃষি উন্নয়নের নামে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র

জঙ্গিবাদে জামায়াতের ‘কৃষিবিদ ব্লক’

Icon

আহমদুল হাসান আসিক

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জঙ্গিবাদে জামায়াতের ‘কৃষিবিদ ব্লক’

কৃষি ও চাষীদের উন্নয়নের নামে গড়ে উঠেছিল তিনটি এনজিও ‘বাংলাদেশ চাষীকল্যাণ সমিতি’, ‘নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং ‘নবধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশন’।

কিন্তু কৃষি বা চাষীদের উন্নয়ন নয়, এর আড়ালে এনজিও তিনটি রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর নেতৃত্বে আছে কৃষিবিদদের নিয়ে গঠিত জামায়াতে ইসলামীর ‘কৃষিবিদ ব্লক’।

তিনটি এনজিওর সব কার্যক্রমই চলে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলের নির্দেশে। তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ আসে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জাকাতের নামে টাকা সংগ্রহ করা হয়। আর সব অর্থ ব্যয় হয় জামায়াতে ইসলামীকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজে।

এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, জামায়াত সমর্থিত এনজিও তিনটির শীর্ষ কর্মকর্তারা (কৃষিবিদ ব্লক) কৃষি উন্নয়নের নাম করে দেশের বাইরে থেকে অর্থ এনে এ দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানোর কাজ করছে। তারা রাষ্ট্র ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এ চক্রের আটজনকে গত ২৮ অক্টোবর গ্রেফতারের পর আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, তিনটি এনজিওরই চেয়ারম্যান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মুহাম্মদ আবদুল করিম। এর মধ্যে ‘নবধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশনে’র নামে সারা দেশে মাঠপর্যায়ের সংগ্রহকারী ‘ভাই’দের মাধ্যমে জাকাতের টাকা সংগ্রহ করা হয়। এমন ২৬ জন ‘ভাই’র একটি তালিকারও সন্ধান মিলেছে, যাদের খোঁজে মাঠে নেমেছেন গোয়েন্দারা। এ ছাড়া গত ১১ বছরে ‘বাংলাদেশ চাষীকল্যাণ সমিতি’র মাধ্যমে এসেছে সাড়ে ৬২ কোটি টাকা বিদেশি অনুদান। দেশি-বিদেশি উৎস হতে সংগৃহীত এসব টাকা নাশকতা ও জঙ্গিবাদের বিস্তারে ব্যয় করেছে জামায়াতে ইসলাম।

সিআইডি জানায়, তিন এনজিও একটি ‘নবধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশনে’র মিরপুর-১২ নম্বরের অফিস থেকে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট ইসমাইল হোসেন নামে এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করে। নবধারায় তাকে পিয়ন হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তার মূল কাজ ছিল অনলাইনে জঙ্গিবাদী মতাদর্শ প্রচার। এ কাজে এ প্রতিষ্ঠানে হাসানুল বান্না নামে আরও এক জঙ্গিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।

এছাড়া গত ১৩ মে কাফরুলের একটি বাসায় কৃষিবিদ ব্লকের সদস্যদের গোপন বৈঠক করার খবর পেয়ে অভিযান চালিয়ে এনজিও তিনটির তিন শীর্ষ কর্মকর্তা আবদুল করিম, ফজলুল হক রিকাবদার, গোলাম রাব্বানীসহ ৯ জনকে গ্রেফতার। জব্দ করা হয় ল্যাপটপসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আলামত। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়। পরে জামিনে বেরিয়ে আবারও তারা সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়।

এরপর সিআইডি অনুসন্ধানে পুরো চক্রকে চিহ্নিত করে তিন এনজিও এবং ১৮ কৃষিবিদকে আসামি করে ২৮ অক্টোবর রমনা থানায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়। তদন্তে দেখা যায়, বাংলাদেশ চাষীকল্যাণ সমিতির ১১ সদস্য কার্যনির্বাহী পরিষদের মধ্যে চেয়ারম্যান আবদুল করিম, সহ-সভাপতি গোলাম রাব্বানী এবং সেক্রেটারি জেনারেল মু. ফজলুল হক রিকাবদার সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। জঙ্গি অর্থায়ন এবং রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এমন অকাট্য প্রমাণ পাওয়ার পর ১৮ জনের মধ্যে ৮ কৃষিবিদকে গ্রেফতার করা হয়, যারা এরই মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। গ্রেফতার আসামিরা হলেন- ফজলুল হক রিকাবদার, হুমায়ুন কবীর, আশরাফুল হক, আসগর হোসাইন, শেখ শাহজাহান কবীর, মনিরুল ইসলাম, আবদুর রউফ এবং আল-মামুন খন্দকার। পলাতক ১০ জন হলেন- মামলার প্রধান আসামি আবদুল করিম, গোলাম রাব্বানী, শেখ জিল্লুর রহমান আজমী, শেখ মুহাম্মদ মাসউদ, ড. সানাউল্লাহ, সিরাজুল হক, এসএম জাকির, নুরুল আমিন ফারুকী, হামিদুর রহমান আযাদ এবং মোস্তাক আহমেদ খাঁ।

সিআইডির ভাষ্য, মানি লন্ডারিং আইনে এর আগে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে মামলা হয়েছিল। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়নি। এবারই প্রথম জামায়াত নিয়ন্ত্রিত তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। জানতে চাইলে মামলার বাদী সিআইডির পরিদর্শক ইব্রাহিম হোসেন যুগান্তরকে বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে মানি লন্ডারিং আইনে মামলাটি করেছি।

চাষীদের নামে আসা বিদেশি অনুদান জঙ্গিবাদে ব্যয় : ২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ চাষীকল্যাণ সমিতির অ্যাকাউন্টে ৬২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বিদেশি অনুদান আসে। অথচ কোনো টাকাই চাষীদের কল্যাণে ব্যয় হয়নি। সামান্য অংশ মসজিদ-মাদ্রাসার উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। বাকি পুরোটাই জামায়াতে ইসলামী দেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ প্রচারণার কাজে ব্যয় করে। নবধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী গোলাম রাব্বানীকে (এখন পলাতক) জিজ্ঞাসাবাদ ও সার্বিক তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ চাষীকল্যাণ সমিতি এনজিওবিষয়ক ব্যুরো থেকে নিবন্ধিত। অপরদিকে নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি আইনে এবং নবধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশন সোসাইটি আইনে নিবন্ধিত। চাষীকল্যাণ সমিতির মাধ্যমে বিদেশি অনুদান আসে। এই অনুদানের টাকা জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের নিদের্শে নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেডের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর হয়। পরে এই টাকা নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেডের কর্মকর্তারা তুলে নেয় এবং জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে জঙ্গিবাদ ও নাশকতাসহ সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়। এনজিও তিনটি কৃষি উন্নয়নে কাজ করার কথা থাকলেও এ বিষয়ে তাদের দৃশ্যমান কোনো কাজ নেই।

জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই তিন এনজিওর সৃষ্টি : সিআইডির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ১৯৭৭ সালে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নায়বে আমীর মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফের উদ্যোগে অনিবন্ধিত হিসেবে ‘বাংলাদেশ চাষীকল্যাণ সমিতি’ যাত্রা শুরু করে। ১৯৯০ সালে এটি এনজিওবিষয়ক ব্যুরো থেকে অলাভজনক এবং সেবামূলক বেসরকারি উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত হয়। অথচ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম লিখিতভাবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলকে অবহিত করা হতো। এই প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আর্থিক কার্যাবলি জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনায় চলত। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলকে অবহিত করে সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের হাতে লেখা দুটি চিঠিও সিআইডি উদ্ধার করেছে।

জাকাতের অর্থ সংগ্রহকারী সেই ২৬ ‘ভাই’ : সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, নবধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের নাম করে সারা দেশ থেকে জাকাতের টাকা তোলা হয়। এজন্য সংস্থাটি সারা দেশে মাঠপর্যায়ে ‘বিশ্বস্ত ভাই’দের নিয়োগ দিয়েছে।

এমন ২৬ ‘ভাই’র একটি হাতে লেখা তালিকা সিআইডির হাতে এসেছে। এরা হলেন- মনির, মুজিব, মুস্তাফিজ, শেখ মাসউদ, শহীদুল্লাহ শরীফ, মতিউর, মির্জা আলী লিয়াকত, মফিজ, মিন্টু, নাজির, আবদুছ ছালাম, জুনেদ, মিজান, মাসুদ (কুমিল্লা), ফিরোজ, ফরিদ, মোশারফ, শাহনেওয়াজ, সিরাজ, উজ্জল ভাই (পটুয়াখালী), শেরেবাংলা মোস্তাফিজ, সাদেক, আখতার, স্বপন, মঈন ও মোশারফ।

এ ছাড়া ওই তালিকায় ইউনিভার্সিটি নামে একটি ঘর খালি রাখা হয়েছিল। মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, নবধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশনটি প্রতি বছর জাকাতের টাকা সংগ্রহ করছে। পরে এসব অর্থ জঙ্গিবাদের বিস্তার ও নাশকতায় ব্যবহার করা হচ্ছে। তালিকায় থাকা ২৬ ভাইয়ের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।

জঙ্গিবাদে জামায়াতের ‘কৃষিবিদ ব্লক’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম