Logo
Logo
×

শেষ পাতা

দক্ষিণের বিএনপির ৪ নেতার আওয়ামী কানেকশন আলোচনায়

গোপন আঁতাতেরও অভিযোগ

Icon

আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল ব্যুরো

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা বিএনপির চার প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে আওয়ামী কানেকশনের অভিযোগ উঠেছে। কেবল আওয়ামী কানেকশনই নয়, আন্দোলন সংগ্রামে তাদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা আর ওয়ান ইলেভেন থেকে এখন পর্যন্ত নানা বিতর্কিত ভূমিকার পরও কিভাবে পদে বহাল রয়েছেন, সে প্রশ্নও তুলেছেন নেতাকর্মীরা। তাদের কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বারবার বিএনপি আন্দোলন সংগ্রামে ব্যর্থ হচ্ছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। অভিযুক্ত নেতারা অবশ্য এসব অভিযোগ স্বীকার করছেন না। তাদের দাবি, দলের অভ্যন্তরে থাকা প্রতিপক্ষ একাদশ নির্বাচনের আগে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। কালের পরিক্রমায় তারা এখন বিএনপির পরীক্ষিত সৈনিক।

এই চার নেতার মধ্যে বির্তকের শীর্ষস্থানে রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী। ওয়ান ইলেভেনের সময় যাকে মাইনাস টু ফর্মুলার ‘অন্যতম কুশীলব’ বলা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৯ বছরে সত্যিকার অর্থে যিনি একদিনের জন্য গ্রেফতার হননি কিংবা জেলে থাকেননি। এজন্য তার আওয়ামী কানেকশনকেই বড় করে দেখছেন অনেকে। স্থানীয় রাজনীতি প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে টিকে থাকার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে আত্মীয়তার সূত্রে ক্ষমতাসীন দলের একেবারে শীর্ষপর্যায়ে তার সু-সর্ম্পকের বিষয়টি। পটুয়াখালী জেলা ছাত্রদল সভাপতি গাজী আশফাকুর রহমান বিপ্লব অভিযোগ করে বলেন, ‘আলতাফ হোসেন চৌধুরীর শ্বশুর ভোলার বাসিন্দা বসরতউল্লাহ চৌধুরী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আলতাফ চৌধুরীর শ্যালিকা মিসেস হেনার স্বামী লুৎফর রহমান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বিএনপি আমলে ভায়রা আলতাফ চৌধুরীর বদান্যতায় পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন লুৎফর রহমান। আলতাফ চৌধুরীর শ্যালক নাজিমউদ্দিন চৌধুরী পালন করছেন একজন অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ছিলেন এই নাজিমউদ্দিন। মূলত এদের সম্বল করেই নিজেকে সব বিপদ থেকে মুক্ত রাখেন চৌধুরী। পাশাপাশি নানা কূটকৌশলে ধরে রাখেন দলীয় পদ-পদবি।’ পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক স্নেহাংশু সরকার কুট্টি বলেন, ‘দলে কোনো পদ-পদবি না থাকা সত্ত্বেও মাসের পর মাস জেলে পচে মরতে হয় আমাদের। অথচ জেলা সভাপতি আর কেন্দ্রের ভাইস চেয়ারম্যান হয়েও গায়ে ফুলের টোকা পর্যন্ত পড়ে না আলতাফ চৌধুরীর। আন্দোলন সংগ্রামেও তাকে দেখা যায় না মাঠে।’ দলীয় নেতাদের এসব বক্তব্য প্রসঙ্গে আলতাফ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘৪০-৫০ বছর আগে করা আত্মীয়তার সর্ম্পক তো আর এখন মুছে ফেলা যাবে না। দলের জন্য অনেক কিছু করেছি বলেই আজ আমার এ অবস্থান। যাদের কথা বলা হচ্ছে তাদের কাছ থেকে কখনও কোনো সুবিধা নেয়ার প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না।’

দলের আরেক ভাইস চেয়ারম্যান বেগম সেলিমা রহমান। মহাজোট সরকারের মন্ত্রী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের বোন। বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে মিলেমিশে রাজধানীতে কয়েকটি মামলার আসামি হলেও মন্ত্রী ভাইয়ের সুবাদে বা যেভাবেই হোক খুব একটা জেলজীবন কাটাতে হয়নি তাকে। প্রায় সার্বক্ষণিকভাবে চেয়ারপারসনের কাছাকাছি থাকা এই নেত্রী দলের কাছে কতটুকু নির্ভরযোগ্য সেই প্রশ্ন বরাবরের। তার ওপর ওয়ান ইলেভেনে সংস্কার ঘোষণা দেয়ার সময় আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার পাশে থাকা আর কঠিনতম সেই মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আস্থায় থেকে নির্বিঘেœ রাজধানীতে বাড়ি নির্মাণকাজ শেষ করার গোপন অনুমতি আদায়ের ঘটনায় মূলধারার কর্মীদের বিরাগভাজন হন তিনি। নির্বাচনী এলাকায় নিজ দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে মন্ত্রী ভাইয়ের দাপট ব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বাবুগঞ্জ বিএনপির এক নেতা যুগান্তরকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে কোনোরকম রাজনৈতিক যোগসূত্র নেই বলে সবসময়ই দাবি করেন সেলিমা রহমান। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে বিএনপি আমলে তিনি যখন প্রতিমন্ত্রী তখন যিনি তার এপিএস ছিলেন, সেই ব্যক্তিই পরে আবার মহাজোটের মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের এপিএসের দায়িত্ব পালন করেন। এর চেয়ে বড় ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ আর কী হতে পারে?’ সেলিমা রহমান অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মন্ত্রী ভাইয়ের কারণে বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ইতিহাস থাকলে দলে এতটা আস্থাভাজন আর গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকতে পারতেন না বলেও তিনি দাবি করেন।

আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার বির্তক পিছু ছাড়েনি বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ঝালকাঠি-২ আসনের সাবেক এমপি শাহজাহান ওমরের। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একজন মন্ত্রীর সঙ্গে গোপন ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে এই নেতার বিরুদ্ধে। ৫-৬ বছর আগে যখন সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি ভেঙে নতুন বিএনপি গড়ার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠে, তখন ওমর যাচ্ছেন সেই নতুন বিএনপিতে- এমন গুঞ্জনও ছিল। আন্দোলন সংগ্রামে কখনই মাঠে না থাকার পাশাপাশি বর্তমান আওয়ামী শাসনামলে একটি মামলার আসামি কিংবা একদিনের জন্যও জেলে যেতে হয়নি তাকে। ঝালকাঠি-২ আসনে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচন করা বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম জামাল বলেন, ‘ওয়ান ইলেভেনে সংস্কারে গিয়ে দলের সঙ্গে বেইমানি করাই কেবল নয়, আরও বহু বছর আগে থেকেই দলে বিতর্কিত রাজনীতি করে এসেছেন তিনি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকারীদের একজন কর্নেল দেলোয়ার তার আপন ভগ্নিপতি। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর দেলোয়ারের লাশ বরিশাল নগরীর রূপাতলী এলাকায় এনে নিজের জমিতে দাফনের ব্যবস্থা করেন ওমর। মাত্র কয়েক বছর আগে পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের জন্ম কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীর কোনো আয়োজনে যোগ তো দিতেনই না, বরং নিজ নির্বাচনী এলাকায় তা করতেও বাধা দিতেন। পরে অবশ্য বিষয়টি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলে মুখরক্ষায় ইদানীং থাকছেন এসব আয়োজনে। মাঝে একবার যখন বিএনপি ভেঙে যায় তখন খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে গিয়েছিলেন ওমর। তার আরেক ভগ্নিপতি আলাউদ্দিনও ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন। কয়েক বছর আগে অবসরে যাওয়া ওই ব্যক্তি ছিলেন এনবিআরের প্রভাবশালী মেম্বার। বিএনপির সময় প্রভাব খাটিয়ে তাকে কর কমিশনার পদে বসিয়েছিলেন ওমর। এই আলাউদ্দিনের মাধ্যমেই ওমর তার বিপুল অঙ্কের কালো টাকা সাদা করেছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।’ দলীয় নেতার এসব অভিযোগ আমলে না নিয়ে শাহজাহান ওমর বলেন, ‘এসব তো মীমাংসিত বিষয়। বিশ্বস্ততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি বলেই তো আমাকে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে তার নির্বাচনী এলাকা তজুমদ্দিন ও লালমোহন এলাকার নেতাকর্মীদের অভিযোগ- এখনও ওয়ান ইলেভেনের প্রেতাত্মা ভর করে আছে হাফিজের ওপর। যে কারণে দলীয় গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে লালমোহন ও তজুমদ্দিনে বিএনপির যে কমিটি তিনি করেছেন, তাতে ঠাঁই পেয়েছেন ওয়ান ইলেভেনে তার সঙ্গে থেকে তালা ভেঙে পল্টন অফিস দখলকারীরা। তজুমদ্দিন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘গত ৯ বছরে যখন বড় কোনো মামলার আসামি না হওয়া কিংবা খুব বেশিদিন তাকে জেলে থাকতে হয়নি, তখন বোঝার বাকি থাকে না যে তিনি কাদের লোক।’ ভোলা জেলা বিএনপি নেতা আক্তারুজ্জামান টিটব বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে এখনও বিএনপির অস্থায়ী মহাসচিব হিসেবে তার নাম রয়েছে। তিনি সেখানে আজ পর্যন্ত কোনো পদত্যাগপত্র কিংবা চিঠি পাঠাননি। ওয়ান ইলেভেনের সময় যখন ইসি থেকে তাকে বিএনপির মহাসচিব হিসেবে চিঠি পাঠানো হয় তখন এর প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছিল বিএনপি। জবাবে হাইকোর্টে রিট পর্যন্ত করেন হাফিজ। এখন হয়ত পদ-পদবি বাঁচাতে ঝুঁকি নেয়ার কিছু নাটক করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আন্দোলন সংগ্রাম কিংবা মামলা জেলজীবন প্রশ্নে কখনই তাকে কোনো জটিলতায় পড়তে হয়নি। মূলধারার বাধার মুখে যে লোক টানা ৭-৮ বছর ধরে নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারেন না, তাকে আর যাই হোক আমরা নেতা হিসেবে মানি না।’ এসব অভিযোগের জবাবে মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের হামলা মামলার বিষয়টি কারও অজানা নয়। আমার বিশ্বস্ততা বিষয়ে দলের শীর্ষ নেতারা খুব ভালো করেই জানেন। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে জানমাল বাঁচাতে অনেক কিছু করতে হয়। তার মানে এই নয় যে, আমি দলীয় আদর্শ থেকে সরে এসেছি। এসবই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক মাহবুব-উল আলম নান্নু যুগান্তরকে বলেন, ওয়ান ইলেভেনের বেনিফিশিয়ারি ও দলকে স্পষ্ট দু’ভাগে ভাগ করা নেতাদের কারণে বরিশালের অনেক জায়গায় মূলধারার নেতাকর্মীরা অবহেলিত। যারা এলাকায় যান না, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে গা-বাঁচিয়ে চলেন, তাদের দিয়ে বিএনপির ভালো হবে না। দলীয় চেয়ারপারসন তাদের ভালো করে জানেন। নিশ্চয়ই তিনি তাদের অতীত বিবেচনায় রেখে ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেবেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম