অগ্নিকাণ্ডের মামলায় সাজার নজির নেই
দায়িত্বহীনতায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ড * ১৫টি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মাত্র তিনটিতে মামলা
হাসিব বিন শহিদ
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কয়েক দশকে দেশে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বহু মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মামলা হয়নি। আবার দু’একটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজার কোনো নজির নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ীদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মামলার পর নানামুখী চাপে আসামিরা গ্রেফতার হলেও কিছু দিন পর জামিন নিয়ে তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, দুই দশকে বাংলাদেশে শিল্পকারখানায় ২৬টির বেশি দুর্ঘটনায় দুই হাজারের মতো শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৫টি অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে মাত্র তিনটি ঘটনার পর মামলা হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা গেলেও তারা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সহসভাপতি আবু বকর ফরহাদ যুগান্তরকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের মামলায় দোষীদের যথাযথ সাজা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে কারখানাগুলোয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের নেতা মোশরেফা মিশু যুগান্তরকে বলেন, অতি লাভের আশায় মালিকপক্ষ অগ্নিনির্বাপক বা সুরক্ষার দিকে তেমন কোনো নজর দেন না। তাদের অবহেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে। নানামুখী চাপে দু-একটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজার কোনো নজির নেই। তিনি বলেন, উপযুক্ত বিচারের মাধ্যমে দোষীদের সাজার নজির সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে শ্রমিকদের জীবনের সুরক্ষার দিকে মালিকরা নজর দেবেন না।
ভয়াবহ তিন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা ও বিচার : ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর মধ্যে মাত্র তিনটি ঘটনায় মামলা হয়। এর মধ্যে তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত শেষে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়া হলেও বিচার কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি। মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। আর চকবাজারের চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি ও বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হলেও তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি। প্রতিটি মামলায়ই আসামিরা জামিনে আছেন। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় ভয়াবহ আগুনে অন্তত ১১২ জনের মৃত্যু ও দুই শতাধিক শ্রমিক আহত হন। ওই দুর্ঘটনায় মামলা হলেও আজও বিচার শেষ হয়নি। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের প্রাণহানির পর অবহেলাজনিত মৃত্যুর মামলা করার মধ্যেই আইনি প্রক্রিয়া সীমাবদ্ধ রয়েছে। দুই বছরেও তদন্ত শেষ হয়নি। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীতে এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে ২৫ জন ও পরে একজনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় উদ্ধারকর্মী ফায়ারম্যান সোহেল মারা যান। এ ঘটনায় বনানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মিল্টন দত্ত একই বছরের ৩০ মার্চ বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলার তদন্তও শেষ হয়নি।
ভয়াবহ সব অগ্নিকাণ্ড কিন্তু মামলা হয়নি : ১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর মিরপুরের সারেকা গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জন পুড়ে মারা যান। ১৯৯৫ সালে ঢাকার ইব্রাহিমপুরের লুসাকা অ্যাপারেলসে অগ্নিকাণ্ডে ১০ জন কর্মী প্রাণ হারান। ১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন এবং সিনটেক্স লিমিটেডের কারখানায় ১৪ জন পুড়ে মারা যান। ১৯৯৭ সালে মিরপুরের তামান্না গার্মেন্টে ২৭ জন এবং মিরপুর-১নং মাজার রোডের রহমান অ্যান্ড রহমান অ্যাপারেলসে আগুনে ২২ শ্রমিক মারা যান। ২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেডে আগুনে ৫৩ শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। ২০০০ সালে বনানীর চেয়ারম্যানবাড়িতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেডে ১২ শ্রমিক অগ্নিকাণ্ডে মারা যায়। ২০০১ সালে মিরপুরের মিকো সোয়েটার লিমিটেডে আগুনের গুজবে পদদলিত হয়ে ২৪ শ্রমিক মারা যান। ২০০৫ সালে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে সান নিটিং গার্মেন্টে আগুনে ২০ শ্রমিক মারা যান। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যালের গুদামে ভয়াবহ আগুনে শিশুসহ ১২৫ জনের মৃত্যু হয়। এসব ঘটনার একটিতেও মামলা হয়নি। দায়ীরা সবাই রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
