৬৩৫ কিমি. ফুটপাতের ৬০ ভাগ বেদখলে
আহমেদ মুসা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নির্বিঘ্নে হাঁটাচলা করতে কিংবা জনচলাচলের জন্য সড়কে ফুটপাত রাখার বিধান রয়েছে আইনে। তবে কত ফুট প্রস্থের ফুটপাত রাখতে হবে সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। এরপরও অন্তত দুজন মানুষ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে-এমন ৪-৫ ফুট প্রস্থের ফুটপাত রাখা জরুরি-এমন মন্তব্য সড়ক নির্মাণসংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের। চট্টগ্রাম নগরীর উত্তরে সিটি গেট থেকে কালুরঘাট, দক্ষিণে শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সড়কে ৬৩৫ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। এর অন্তত ৬০ শতাংশই অবৈধ দখলে চলে গেছে। শুধু ফুটপাত নয়, কোথাও কোথাও ফুটপাত ছাড়িয়ে সড়কও গিলে খেয়েছে অবৈধ দখলদাররা। বিশেষ করে সড়কের পাশের দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা-বাড়ি বা ভবন মালিকরা ফুটপাত দখলে এগিয়ে রয়েছেন। ভাসমান হকাররাও ফুটপাতের বিশাল একটি অংশ দখলে রেখেছে। কোথাও আবার ফুটপাত দখল করে চলছে নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা। এমন পরিস্থিতিতে নগরীর জনচলাচলের ফুটপাত যেন জনভোগান্তিতে পরিণত হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বলছে, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে বা অবৈধ হকার উচ্ছেদে তারা মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও সে অভিযানে স্থায়ী সফলতা আসে না। কখনো কখনো উচ্ছেদ কর্মীদের উলটো অবৈধ দখলদারদের তাড়া খেয়ে ফিরতে হয়। আবার কোথাও কোথাও উচ্ছেদের পর দু-একদিন দখলমুক্ত থাকলেও পরে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে ফুটপাত। জনচলাচলের এই ফুটপাত দখল-বেদখল নিয়ে হয় লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজিও। কোনো কোনো স্থানে আবার ফুটপাত দখলে সহযোগী ভূমিকা পালন করে পুলিশের সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে সিএমপির এডিসি (জনসংযোগ) আরাফাতুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, নগরীর অনেক ফুটপাত দখল হয়ে গেছে এবং ফুটপাত দখলের কারণে জনদুর্ভোগ ও ভোগান্তি বাড়বে সেটা স্বাভাবিক। তবে ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদা আদায়ের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। যদি এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায় অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে এবং খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেছে, নগরীর বহদ্দারহাট, নিউমার্কেট, রিয়াজউদ্দিন বাজার, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, টেরিবাজার, জুবিলী রোড, কোতোয়ালি মোড়, সদরঘাট রোড, স্টেশন রোড, বায়েজিদ বোস্তামী, কর্নেল হাটসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়ক ও জংশনে ফুটপাত দখলের ভয়াবহ প্রতিযোগিতা রয়েছে। এসব প্রতিযোগিতায় ব্যবসায়ী, হকার তথা পুলিশের ভূমিকা মুখ্য। অভিযোগ আছে, প্রতিটি থানা এলাকাতেই ফুটপাত দখলের নেপথ্যে অবৈধ দখলদারদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রয়েছে থানা পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তান। কোনো কোনো স্থানে ফুটপাত ছাড়িয়ে মূল সড়কে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে হকাররা। নগরীর বিভিন্ন সড়কে নিত্য যানজটের এটিও অন্যতম কারণ। চট্টগ্রামে তালিকাভুক্ত ১০ হাজার হকারের কাছ থেকে দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয় বলেও ফুটপাতের ভুক্তভোগী হকারদের অনেকে অভিযোগ করেছেন। তারা বলছেন, ভাসমান হকারদের বিকল্প আয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে হকাররা ফুটপাতে বাণিজ্য করে। কিন্তু এটি করতে গিয়ে তাদের পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানদের চাঁদা দিতে হয়।
ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন রিয়াজউদ্দিন বাজার, নিউমার্কেট, সদরঘাট, জিপিও, আমতল ও জুবিলী রোড এলাকায় সরেজমিন দেখা গেছে, এই এলাকার প্রতিটি সড়কের দুই পাশেই রয়েছে ফুটপাত। এসব ফুটপাতের কোথাও ভাসমান হকার, কোথাও রাস্তার পাশের দোকানদারদের জিনিসপত্র রেখে ফুটপাত দখল করে চলে বাণিজ্য। ফল ও বিভিন্ন ধরনের পোশাকসহ রকমারি পণ্যের পসরা সাজয়ে ফুটপাতে ব্যবসা করেন তারা। সদরঘাট কালিবাড়ী রোডের ফুটপাত যেন সাইকেল ও সাইকেল পার্টস বিক্রেতাদের যেন স্থায়ী সম্পত্তি। স্টেশন রোড ও ফলমণ্ডির ফুটপাত বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে ঢাকা থাকায় চোখে পড়াও দায়। স্টেশন রোডের ফুটপাতে দীর্ঘদিন ধরে ভ্যান বসিয়ে ফলের ব্যবসা করেন হকার আবু তাহের। ফুটপাত দখল করে ব্যবসা পরিচালনা করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা পেটের দায়ে হকারি করি। আমাদের পুঁজিও কম। তাই দোকান নিয়ে ব্যবসা করার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু ফুটপাতে ব্যবসা করলেও এলাকার পাতিনেতা, মাস্তান ও পুলিশকে দৈনিক হারে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় বলে জানান। এই এলাকার প্রতিটি ফুটপাতে যারা ব্যবসা করেন কোতোয়ালি থানা পুলিশ ও সিআরবি পুলিশ ফাঁড়ির লোকজনকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয় বলে তাদের অভিযোগ। কোতোয়ালি থানার উলটো পাশে দক্ষিণের সড়কেও ফুটপাতের ওপর একাধিক স্থায়ী ফলের দোকান বসানো হয়েছে। এসব দোকানের কারণে এই ফুটপাতে মানুষ হাঁটা দায়। অভিযোগ আছে পুলিশ ও আলকরণে এলাকার সরকারদলীয় কতিপয় লোক ফুটপাতের এসব দোকান থেকে মাসহারা নেন। চসিকের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন এই এলাকা হকার উচ্ছেদে বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করেন নিজে উপস্থিত থেকে। এক হকার নেতার কলার ধরে শাসানোর নজিরও রয়েছে। তিনপুলের মাথা থেকে লাভলেন পর্যন্ত আধা কিলোমটিার সড়কের দুই পাশের ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে মেশিনারিজ, ইলেক্ট্রনিক্স আইটেম, ফার্নিচার, স্যানিটারি আইটেমসহ বিভিন্ন প্রকার পণ্যসামগ্রীর দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নিজেদের প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে ফুটপাতজুড়েই পণ্যসামগ্রী সাজিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। ফুটপাত দখল করে বাণিজ্য করার পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের মালামাল লোড-আনলোড হয় ব্যস্ততম এই সড়কটির দুই পাশে ট্রাক-পিকআপ কাভার্ডভ্যান রেখে। তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে এই সড়কে। নগরীর ব্যস্ততম আগ্রাবাদ শেখ মুজিব সড়কের দেওয়ানহাট মোড় থেকে আগ্রাবাদ মোড় পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়কের ফুটপাত অনেক আগেই গিলে ফিলেছে হকার ও ব্যবসায়ীরা। দুই পাশের বেশির ভাগ অংশ গাড়ির গ্যারেজ মালিক ও মোটার পার্টস ব্যবসায়ীরা দখল করে রেখেছেন। ফুটপাত ছাড়িয়ে তাদের দখলের থাবা গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কের বিশাল অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ কারণে এই ফুটপাতে জনচলাচল দূরে থাক, সামনের সড়কে যান চলাচলেও ভোগান্তি পোহাতে হয়। নগরীর ইপিজেড মোড় থেকে শুরু করে বন্দরটিলা এবং ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ চৌধুরী কলেজ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশের ফুটপাত বেদখল হয়ে গেছে। ইপিজেড মোড়ের আগে রাস্তার বামপাশে রয়েছে শাকসবজি ও তরকারির আড়ত। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাকে ট্রাকে তরকারি এনে সেখানে খালাস করা হয়। আর এসব তরকারি রিকশা-ভ্যান, মিনিট্রাক ও ঠেলাগাড়িতে ভরে নগরীর বিভিন্ন বাজারে পাঠানো হয়। এসব কাজ করা হয় রাস্তার ওপর। এতে সকাল থেকেই ওই এলাকায় তীব্র যানজট হয়। নগরীর একমাত্র ছয় লেনবিশিষ্ট বহদ্দারহাট-শিকলবাহা ৮ কিলোমিটার মহাসড়কের ফুটপাত ছাড়াও সড়কের অর্ধেকই (শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত) বেদখল হয়ে গেছে। ছয় লেন সড়কের মধ্যে দুই লেনই অনেকটা দখল হয়ে গেছে। শাহ আমানত সেতু হতে বহদ্দারহাট পর্যন্ত নগরীর ৫ কিলোমিটার অংশে উভয় দিকের বামপাশের লেন দুটিতে গাড়ির গ্যারেজ, গাড়ি পার্কিং, কমিউনিটি সেন্টারের পার্কিং ও দোকানের মালামাল রেখে দখল করে সংকুচিত করা হয়েছে। সরকার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মহাসড়ক নির্মাণ করলেও অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে এর সুফল পাচ্ছে না নগর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের কয়েক লাখ মানুষ। রাস্তাটির উভয় পাশে অবৈধ দখলের কারণে চলাচলরত মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। একই অবস্থা নগরীর অন্যতম পোর্ট কানেকটিং সড়ক। এই সড়কে জনচলাচল কম থাকলেও সড়কের দুই পাশ যেন অঘোষিত ট্রাক টার্মিনাল। গত ২৬ আগস্ট কোতোয়ালি থানাধীন কদমতলী এলাকায় ফুটপাত দখল করে নির্মাণাধীন স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্ন বিভাগের এক সুপারভাইজারসহ অন্তত ৫ জন। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক আবু তাহের সিদ্দিকী, সুপারভাইজার উত্তম ও পে-লোডার চালক মহিউদ্দিন ছিলেন। তাদের ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। জনি রাজিব রাজু মিলন ও রনির নেতৃত্বে ৩০-৪০ সন্ত্রাসী লাঠিসোটা হাতে নিয়ে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে উচ্ছেদে অংশ নেওয়া করপোরেশনের লোকজনের ওপর। ওই ঘটনায় ফুটপাতের অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করা হয়।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস চেয়ারম্যান এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, ফুটপাত নির্মাণ করা হয় জনচলাচলের জন্য। সেসব দখল করে যদি ব্যবসা পরিচালনা করা হয় তাতে জনগণকেই তার হাঁটার অধিকার চলার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফুটপাত দখল ও এর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেপথ্যে থাকা রাঘব বোয়ালদের চিহ্নিত করা উচিত। হকারদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ফুটপাত উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত সিটি করপোরেশনের।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী বিপ্লব যুগান্তরকে বলেন, ‘নগরীতে ৬৩৫ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। এসব ফুটপাতের সিংহভাগ অবৈধ দখলে থাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। কিন্তু উচ্ছেদের পর আবারও আগের অবস্থায়ই ফিরে আসে দখলদাররা। ফুটপাত বা দখলকারীদের জরিমানা বা সাজা দেওয়া গেলে হয়তো ফুটপাত দখল কিছুটা কমানো যেত।
