সরেজমিন ঢাকা উত্তর সিটির ৪২নং ওয়ার্ড
বেরাইদের প্রধান সমস্যা ময়লা-আবর্জনা, মশা
অধিকাংশ রাস্তাই সরু * সড়কবাতি না থাকায় রাতে নেমে আসে ভূতুড়ে অন্ধকার
এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকা উত্তর সিটির বেরাইদে কচুরিপানা ভর্তি ডোবা-খালে জন্ম নিচ্ছে মশা। ভোগান্তির শিকার এলাকাবাসী। শুক্রবার তোলা -যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪২ নম্বর ওয়ার্ড ‘বেরাইদ’। ডিএনসিসিতে যুক্ত হওয়া নতুন আট ওয়ার্ডের একটি। অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ বেরাইদ যেন পুরান ঢাকার ‘রেপ্লিকা’ (প্রতিরূপ)। ঢাকাকে বলা হয় ‘মসজিদের নগরী’। আর বেরাইদকে বলা হয় ‘মসজিদের গ্রাম’।
এই ওয়ার্ডে রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি পাঁচ শতাধিক বছরের ‘ভূঁইয়াপাড়া মসজিদ’। এছাড়াও আছে ১৪টি মসজিদ। মন্দির আছে পাঁচটি। একটির বয়স দুইশ’ বছরের বেশি।
ওয়ার্ডটির আয়তন ৬ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা আনুমানিক ৬০ হাজার। সময়ের পরিক্রমায় ঘর-বসতি, অলিগলি বেড়েছে। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সমস্যা। এর মধ্যে আছে-ময়লা-আবর্জনা, কাঁচা সড়ক, জলাবদ্ধতা, বিশুদ্ধ পানির অভাব, মশা, বিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ খুঁটি, সড়কে বৈদ্যুতিক বাতি না থাকা ও তরুণ-যুব সমাজের মধ্যে মাদকাসক্তি।
ঘিঞ্জি জনপদ বেরাইদের বড় সমস্যা ময়লা-আবর্জনা। মানুষজন যত্রতত্র গৃহস্থালির ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। কখনও পলিথিনে ভরে, কখনও খোলা অবস্থায় পথের ধারে, খালের মুখ, নর্দমা, নদীরপাড় যে যেখানে পারছে ময়লা ফেলছে। এর ফলে জমছে আবর্জনার স্তূপ-ভাগাড়। এখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা হাজী নুরুল হক বলেন, এই সমস্যার আশু সমাধান দরকার।
‘স্যাটেলাইট ট্রান্সফার স্টেশন’ (এসটিএস) স্থাপন করে নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা সংগ্রহ ও সেখান থেকে অপসারণ জরুরি। এই ওয়ার্ডে অনেক কাঁচা সড়ক রয়েছে। ফকিরখালি বাজার থেকে উত্তরে গাবরখালি খাল ও বালুনদ পর্যন্ত রাস্তাটি কাঁচা। বাজার থেকে দক্ষিণে ফকিরখালি কেন্দ্রীয় মসজিদ, ব্রিজ পর্যন্ত ব্রিকসলিং করা হলেও কার্পেটিং হয়নি। বেরাইদ হাটখোলা/সারকুলার রোড চিনাদি মহল্লার দক্ষিণে গিয়ে শেষ হয়েছে।
এই সড়কের ব্রিকসলিং অনেক জায়গায় উঠে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এর শেষ মাথা থেকে পশ্চিম অংশের কাজ শেষ করা দরকার বলে মনে করেন চিনাদীবাসী।
এছাড়া চিনাদী ব্রিজ থেকে খালের উত্তরপাশে বেপারি বাড়ি, মোড়লপাড়া হয়ে সড়কটি আলহাজ রাহীমুল্লাহ মোল্লা রোডে সংযুক্ত করতে হবে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দা সাজিদুর রহমান সাজিদ। তাহলে বেরাইদ সারকুলার রোড পূর্ণতা পাবে। ফকিরখালি কবরস্থান রোড, ডগরদিয়া রোড, অ্যাডভোকেট মোস্তফা আবুল হোসেনের বাড়ি পর্যন্ত কাঁচা রাস্তাটি পাকা করতে হবে।
বেরাইদ নামাবাজার থেকে ১০০ ফুট (বারিধারা-বেরাইদ সড়ক) পর্যন্ত সংযোগ সড়কের সলিং উঠে গেছে। সংস্কার ও পাকা করার দাবি জানিয়েছেন হাজী বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া। পাঁচদিরটেক রোডে একটু বৃষ্টিতেই হাঁটুপানি জমে বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
বেরাইদের প্রধান সড়কটি খুবই সরু। দুটি রিকশা পাশাপাশি অতিক্রম করা কষ্টকর। কার, মাইক্রোবাস, পিকআপ ঢুকলে যানজট লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার সুযোগ নেই। অগ্নিকাণ্ড বা দৈবদুর্বিপাকে এখানে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
প্রধান সড়কের ড্রেন মান্ধাতা আমলের। ভূঁইয়াপাড়া মহল্লা, ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়, টানবাজার থেকে পূর্বদিকে স্কুলের ওয়ালঘেঁষে চলে যাওয়া ড্রেনটি পূর্বপাড়া মসজিদের কোনা দিয়ে পুরান ঈদগার পাশে খালে পড়েছে। এটি বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের উপযোগী নয়। বৃষ্টি হলেই ড্রেন উপচে বেরাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেরাইদ মুসলিম হাইস্কুল মাঠে হাঁটুপানি জমে। কার্যকর সারফেস ড্রেনের অভাবে নামাবাজারে একই অবস্থা হয়। জলাবদ্ধতা তৈরি হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম রহমতউল্লাহ স্টেডিয়ামে। ভূঁইয়াপাড়া মসজিদ ও হাইস্কুলের উত্তরপাশের রোড মূল স্যুয়ারেজ লাইনে সংযুক্ত করা দরকার।
আশির দশকে বসানো বিদ্যুতের খুঁটি একদফা পালটালেও অনেক ফের ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অনেক জায়গায় খুঁটি থেকে বাসা-বাড়িতে দেওয়া সংযোগ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। সড়কবাতি নেই। সাবেক কাউন্সিলর ফারুক আহম্মদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে বসানো সড়কবাতিগুলো উধাও হয়েছে বহু আগেই। ফলে রাতে সড়ক ও অলিগলিতে নেমে আসে ভূতুড়ে অন্ধকার। এ কারণে বেড়েছে চুরি ও মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্য।
গ্রামের পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বালু নদের পানি দূষণের ফলে গৃহস্থালি ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের অযোগ্য। ওয়ার্ডবাসীর বিশুদ্ধ পানীয় জলের একমাত্র ভরসা টিউবওয়েল। কিন্তু পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েলের পাইপে পানি ওঠে না। লোকজন ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাবমারসিবল পাম্প বসিয়ে বৈদ্যুতিক মোটরে পানি তুলছেন। কেউ কেউ এই সুযোগে ব্যবসায়ও করছেন।
একদিকে নদী ও তিনদিকে খালবেষ্টিত ডিএনসিসি’র ৪২ নম্বর ওয়ার্ড-বেরাইদ। এখানে অবাধে চলছে খাল দখল। পাকা স্থাপনা গড়ে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছেন অনেকেই। একসময় খালে স্রোত বইত। এখন পলি পড়ে মৃত নালায় পরিণত হয়েছে। খাল ও ডোবায় কচুরিপানা জমে সেগুলো যেন মশা উৎপাদন খামারে পরিণত হয়েছে। মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ ওয়ার্ডবাসী।
স্থানীয়দের দাবি ছিল, ‘আগে উন্নয়ন, পরে সিটি করপোরেশন’। বাস্তবে করপোরেশনে উন্নীত হলেও উন্নয়ন সুদূর পরাহত। তারা সিটি নয়, খোদ রাজধানীতে আছেন, কিন্তু নাগরিক সুযোগ সুবিধাবঞ্চিত। ফকিরখালির সাবেক ইউপি সদস্য সুজন বলেন, নাগরিক সুবিধা না বাড়লেও বেড়েছে ভূমি উন্নয়ন কর, আমাদের ওপর চেপেছে করের বোঝা। মাদকব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের উৎপাতে জনজীবন অতিষ্ঠ। বিকালে বাইকের ঢল নামে বালু নদ তীরবর্তী হাটখোলা ও ৩০ ফুট সড়কে। চলে বহিরাগত মাদকসেবীদের আনাগোনা। পুলিশের উপস্থিতি টের পেলে পালিয়ে যায় তারা। প্রশাসন ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে আছেন।
একসময় বেরাইদ ইউনিয়ন ছিল বিশাল আয়তনের। সেটি ভাগ করে তিনটি ইউনিয়ন হয়। বেরাইদ, ডুমনি ও নাসিরাবাদ ইউনিয়ন। স্বতন্ত্র বেরাইদ ইউনিয়ন পরে রাজধানীর একটি ওয়ার্ডে উন্নীত হয়। উন্নয়ন হয়নি। বরং ঘটছে অপরিকল্পিত নগরায়ন, জনগণের ওপর চাপছে বাড়তি করের বোঝা।
২০১৬ সালের ৯ মে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার) নাগরিক সেবা বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে রাজধানীর ১৬টি ইউনিয়নকে দুই সিটি করপোরেশনভুক্ত করে। এর মধ্যে আটটি ইউনিয়ন পড়েছে ঢাকা উত্তর সিটিতে। এসব এলাকা নিয়ে ১৮টি ওয়ার্ড গঠন করা হয়। বেরাইদ ডিএনসিসির নতুন ওয়ার্ডের একটি।
কাউন্সিলর আইয়ুব আনছার মিন্টু বলেন, এসটিএস স্থাপনে খাস জমি চিহ্নিত করে ‘প্রকল্প প্রস্তাব’ জমা দেওয়া হয়েছে। সুপরিসর খেলার মাঠ, আধুনিক কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণের প্রস্তাব করেছি। সড়ক নির্মাণ, পুরনো সড়ক মেরামত ও কার্পেটিংয়ের পরিকল্পনা জমা দেওয়া আছে। বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছি। ইতিমধ্যে ঘোষিত বাজেটের অর্থ ছাড় পেলে সবই করা সম্ভব। আশাকরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং আমাদের সম্মানিত মেয়র আতিকুল ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করা সম্ভব হবে, ইনশাআলাহ।
