Logo
Logo
×

শেষ পাতা

কক্সবাজার কটেজ জোনে আতঙ্কের নাম আশিক

অর্ধশত নারী ধর্ষণের অভিযোগ আশিক ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে, সদর থানায়ই আশিকের বিরুদ্ধে মামলা ১৬টি

Icon

জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার 

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কক্সবাজার কটেজ জোনে আতঙ্কের নাম আশিক

কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে ধর্ষক ইসরাফিল জয় (চিহ্নিত) -সংগৃহীত

কক্সবাজারে নারী পর্যটককে গণধর্ষণের হোতা আশিকুল ইসলাম আশিক ধীরে ধীরে অপরাধ জগতের গডফাদার হয়ে উঠেছেন। জেলার সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের মূল হোতা আশিকের নেতৃত্বে অন্তত তিন ডজন অপরাধীর চক্র এখন সক্রিয়।

অভিযোগ রয়েছে যে, কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তার এই বাড়বাড়ন্ত। পর্যটন এলাকার ত্রাস বলা হয় তাকে। পুলিশ বলছে, কেবল কক্সবাজার সদর থানায়ই অস্ত্র, ইয়াবা, ছিনতাইসহ অন্তত ১৬টি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মাঝেমধ্যে কারাগারে গেলেও বের হয়ে আবার অপরাধ জগতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এই আশিক। 

শহরের কটেজ জোন লাইটহাউস সরণিতে যৌনপল্লী হিসাবে কয়েকটি কটেজে তার নিয়মিত আসা-যাওয়া রয়েছে। সেখানকার অর্ধশতাধিক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ এই আশিক এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বিরুদ্ধে। 

এসব কটেজে আসা শতাধিক পর্যটকসহ কটেজ ও কর্মচারীদের উলঙ্গ করে ভিডিও ধারণ করে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার হাত থেকে বাদ যাননি পুলিশও। মৌখিকভাবে এসব বিষয়ে কটেজ ব্যবসায়ীরা পরিচিত পুলিশ সদস্যদের কাছে নালিশ করলেও তাতে কাজ হয়নি।

তবে নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে বা ভয়ে আশিকের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করতে সাহস পায়নি। জানা গেছে, লাইটহাউস সরণি এলাকার অর্ধশতাধিক কটেজে অসামাজিক কার্যকলাপ চলে দিনরাত। এসব কটেজে নারী ছাড়া হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মরণ নেশা ইয়াবা। 

পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানান, প্রায়ই রাত সাড়ে ৯ থেকে ১২টা পর্যন্ত একাধিকবার তাদের কটেজে হানা দেয় আশিক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। অনেক সময় পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য আসা তরুণীদের মারধর করে তাদের মোবাইল, টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সুন্দরী মেয়েদের জোরপূর্বক ধর্ষণ করা ছিল আশিকের নেশা।

জানা গেছে, গত দেড় মাসে অন্তত ৫০ বারের বেশি এসব কটেজে হানা দিয়েছেন আশিক। প্রত্যেক বারই ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো না কোনো তরুণীকে ধর্ষণ করেছেন আশিক এবং তার সঙ্গীরা। কথা হয় ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া জলির (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার বাবা মারা গেছে কয়েক বছর আগে।

পরিবারের ভার বহনের পাশাপাশি নিজেও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। করোনা ধাক্কায় টিউশনি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সীমাহীন আর্থিক সংকটে পড়ে যাই। এক পর্যায়ে আমার এক বান্ধবীর ফাঁদে পড়ে গত ৬ মাস আগে কক্সবাজারে চলে আসি। এরপর বাধ্য হয়ে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ি।

তিনি দাবি করেন, গত ২৪ বা ২৫ নভেম্বর রাতে আমার কটেজে হানা দেয় আশিক। তখন তার ভয়ে সেখানকার কর্মচারীরা সবাই সটকে পড়েন। আশিক প্রথমে ছুরি মারার ভয় দেখিয়ে কটেজে থাকা সব মেয়ের সঙ্গে অন্তত ১৫ পর্যটকের মোবাইল ও টাকা-পয়সা কেড়ে নেন। পরে পর্যটকদের উলঙ্গ করে মেয়েদের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে ভিডিও ধারণ করেন। 

জলি বলেন, ওইদিন আমাকেও উলঙ্গ করে ভিডিও ধারণ করে। যাওয়ার সময় আমার মোবাইল নম্বর নিয়ে ফোনটি ফেরত দিয়ে মোবাইল বন্ধ পেলে ভিডিও ভাইরালের হুমকি দিয়ে যান আশিক। মেয়েটি বলেন, ঘটনার একদিন পর আমাকে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে দেখা করতে বলেন আশিক।

দেখা করার পর ওইদিন রাতে অপরিচিত একটি বাড়ির ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে ইয়াবা সেবন করে রাতভর আমাকে ধর্ষণ করেন আশিক আর তার আরেক বন্ধু। তার দাবি, আশিক অন্তত ৪০ থেকে ৫০ জন মেয়ের সঙ্গে একই ধরনের আচরণ করেছেন বলে জানতে পেরেছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব অভিযোগ অকপটে স্বীকার করেছেন ওইসব কটেজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি। তারা জানিয়েছেন, গত এক মাসে এসব কটেজে আসা পর্যটক ও কটেজের মালিক-কর্মচারীদের ধরে নিয়ে তাদের উলঙ্গ করে মেয়েদের সঙ্গে ছবি তুলে অর্থ আদায় করেছে আশিক।

এসব তার নেশায় পরিণত হয়েছে। জানা গেছে, কয়েকদিন আগে দুটি কটেজের দুই জন স্টাফকে তুলে নিয়ে তাদেরকে মারধর ও উলঙ্গ করে ভিডিও ধারণ করেন আশিক। পরে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করা হয়।

এসব কটেজের ব্যবসায়ীরা জানান, নিজেরা অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকায় আশিকের বিরুদ্ধে মামলা করতে ভয় পাচ্ছেন তারা। তবে ‘মাসোহারা’ আদায় করা পরিচিত পুলিশ অফিসারদেরকে আশিকের বিষয়ে অভিযোগ দিলেও তারা ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন।

কক্সবাজার শহরের এসব অবৈধ কার্যকলাপ বন্ধের পাশাপাশি ধর্ষণে জড়িতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে সচেতন মহল। জানতে চাইলে কক্সবাজার পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান বলেন, কটেজ ব্যবসায়ী বা পর্যটকদের কেউ অভিযোগ করেনি।

এর পরও অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। একইসঙ্গে অসামাজিক কার্যকলাপ চলা কটেজগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি। একই কথা বলেছেন কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশের এসপি জিল্লুর রহমান। 

আশিকের আশ্রয়দাতা কে?

কক্সবাজারে আশিকের সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের মূল হোতা হয়ে ওঠার পেছনে যাদের হাত রয়েছে তাদের মধ্যে প্রথমেই আসে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের নাম। জেলায় নিজের আধিপত্য বিস্তারে আশিকের গ্রুপকে প্রশ্রয় দিতে শুরু করে।

২১ ডিসেম্বর রাতেও সাদ্দামের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডায় মেতেছিল ধর্ষক আশিক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। বাহারছড়া ল্যাবরেটরি স্কুলের পাশে এই আড্ডায় আশিক, জয়, রেশাদ, মোবারক সবাই ছিল। পরে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম সেন্টমার্টিন চলে যান। আর ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটে ২২ ডিসেম্বর রাতে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পর্যটন এলাকা কলাতলিতে ইয়াবা ব্যবসা, ছিনতাই, অপহরণসহ সব ধরনের অপকর্ম হয় আশিকের নেতৃত্বে। জানা গেছে, আশিক গংরা এক সময় ছাত্রদল করত। সাদ্দাম নেতা হওয়ার পর ক্ষমতা জানান দিতে এবং নিজের ভিত্তি মজবুত করতে ওদের আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠেন।

কক্সবাজার শহরের বাইরে বাড়ি হওয়ায় আধিপত্যের বিচারে সাদ্দাম কিছুটা দুর্বল ছিল। ফলে ছাত্রদলের হলেও জয়, আশিক গংয়ের নিজের করে নিতে কোনো দ্বিধা ছিল না তার। জেলা ছাত্রলীগের একজন নেতা বলেন, এই ঘটনার পর ধর্ষক গ্যাংয়ের অন্যতম সদস্য মোবারকের নামে মামলা হলে সাদ্দাম সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে নিজেকে মামলা থেকে বাঁচাতে।

ঘটনার পর ধর্ষকদের কয়েকজনের সঙ্গে সাদ্দামের ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে সাদ্দামের দাবি, ওদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

সাদ্দাম বলেন, ‘ছবি থাকাই ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করে না। আমাদের সঙ্গে অনেকেই ছবি তুলতে চায়। আমরা নিষেধ করি কীভাবে।’ তার দাবি, আশিক, জয়, মোবারক, রেশাদ, বিজয় কাউকেই তিনি চেনেন না।

ওরা ছাত্রলীগের কোনো পর্যায়ের নেতাও নয়। এ বিষয়ে কক্সবাজার পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান বলেন, অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা যত ক্ষমতাশালী হোক না কেন প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 

আশিক কক্সবাজার নারী পর্যটক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম