ইউরিয়া সারের দাম বাড়ল কেজিতে ৬ টাকা
প্রতি কেজি ইউরিয়া সার ২২ টাকা, সোমবার থেকেই কার্যকর * অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কেজিতে ৬ টাকা বাড়ল ইউরিয়া সারের দাম। ফলে কৃষককে প্রতি কেজি সার ১৬ টাকার পরিবর্তে ২২ টাকায় কিনতে হবে। শতকরা হিসাবে এই বৃদ্ধি প্রায় ৩৮ শতাংশ। আর একজন ডিলার পর্যায়ের দাম ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করা হয়েছে। সোমবার থেকেই নতুন দাম কার্যকর হয়েছে। তবে দেশে সারের মজুত পর্যাপ্ত। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
দাম বাড়ানোর কারণ হিসাবে মন্ত্রণালয় বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও ইউরিয়ার ব্যবহার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে এ সিদ্ধান্ত। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর ফলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। বাড়বে শিল্পের কাঁচামালের দাম। সামগ্রিকভাবে যা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সারের দাম বেড়েছে। এক্ষেত্রে দেশের বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকারের কাছে বিকল্প ছিল ভর্তুকি বাড়ানো। বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির যে অবস্থা, সেখানে ভর্তুকি বাড়ানো কঠিন। সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্যের দামে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এছাড়াও দাম বাড়বে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন শিল্পপণ্যের। সামগ্রিকভাবে যা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে। অর্থাৎ এমনিতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছিল। সেটি আরও বাড়বে।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৮১ টাকা। এর ফলে ৬ টাকা দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে প্রতি কেজিতে ৫৯ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। ডিএপি সারে শতকরা ১৮ শতাংশ নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের উপাদান রয়েছে। সেজন্য ডিএপির ব্যবহার বাড়িয়ে ইউরিয়া সারের অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য সরকার ডিএপি সারের মূল্য প্রতি কেজি ৯০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকা করে কৃষকদের দিয়ে যাচ্ছে। এ উদ্যোগের ফলে বিগত কয়েক বছরে ডিএপি সারের ব্যবহার দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে ডিএপি ব্যবহার হতো ৮ লাখ টন, বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে ১৬ লাখ টন। ডিএপি সারের ব্যবহার বাড়ার ফলে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমার কথা। কিন্তু বাস্তবে ইউরিয়ার বেড়েছে। ২০১৯ সালে ইউরিয়া ব্যবহার হতো ২৫ লাখ টন, বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন।
অন্য আরেকটি সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। এক্ষেত্রে ভর্তুকি কমাতে আইএমএফের চাপ রয়েছে। সারের দাম বাড়ানোর এটিও একটি কারণ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশে তিন ধরনের পণ্যের আমদানি মোট আমদানি ব্যয়ের ৩০ শতাংশের বেশি। এগুলো জ্বালানি, খাদ্য ও সার। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে তিন ধরনের পণ্যের দামই অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতে সারে সরকারের ভর্তুকিও বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত সারে মোট ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চাহিদার বিপরীতে দেশে সব ধরনের সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। আমন মৌসুমে (জুলাই- সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা ৬ লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন, বিপরীতে বর্তমানে মজুত রয়েছে ৭ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন, যা প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় ১ লাখ টন বেশি। অন্যান্য সার যেমন টিএসপির আমন মৌসুমে চাহিদা ১ লাখ ১৯ হাজার টন, বিপরীতে মজুত ৩ লাখ ৯ হাজার টন, ডিএপির চাহিদা ২ লাখ ২৫ হাজার টন, বিপরীতে মজুত ৬ লাখ ৩৪ হাজার টন এবং এমওপির চাহিদা ১ লাখ ৩৭ হাজার টন, বিপরীতে মজুত রয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার টন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত বছরে দেশে মোট রাসায়নিক সারের চাহিদা নিরূপণ হয় ৫৯ লাখ ৩৪ হাজার টন। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৬ দশমিক ৫০ লাখ টন। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদন ৫০ শতাংশ। বাকি আমদানি করতে হয়। এছাড়াও টিএসপি চাহিদা ৭ দশমিক ৫০ লাখ, ডিএপি ৯ লাখ, এমওপি ৮ দশমিক ৫০ লাখ ও এমএপি শূন্য দশমিক ৫০ লাখ টন। অন্যান্য রাসায়নিক সারের মধ্যে জিপসাম ৪ লাখ টন, জিংক সালফেট ১ লাখ ৩৩ হাজার, অ্যামোনিয়াম সালফেট ১০ হাজার, ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ৮০ হাজার ও বোরন ৪১ হাজার টন। অন্যদিকে এনপিকেএস ৭০ হাজার টন নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব সারের বাজারমূল্য থেকে অনেক কম মূল্যে সারের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকার ভর্তুক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর ডিজেলের দামও বাড়ানো হয়েছে। এতে সেচের খরচ বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি সারও বাড়তি দামে কিনতে হয় তবে কৃষক আগামী বছর ধান আবাদে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন, যাতে চালের সংকট আরও বাড়াবে।
