মানব পাচারের শিকার
নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে মাদারীপুরে মুক্তিপণ আদায়
মাদারীপুর ও টেকেরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে অল্প খরচে ইতালি পাঠানোর কথা বলে প্রথমে নেওয়া হয় লিবিয়ায়। সেখানে দুর্গম স্থানে আটকে রেখে চালানো হয় নির্যাতন। কখনো সেই নির্যাতনের ভিডিও পাঠানো হয় স্বজনদের কাছে। আবার কখনো ভিডিও কলে দেখানো হয় সেই নির্মম নির্যাতন। নির্যাতন করা হয় শুধু মুক্তিপণ আদায়ের জন্যই। এমন একটি চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে মাদারীপুরে। একাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এ লোমহর্ষক তথ্য। চক্রটি প্রথমে অল্প খরচে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার প্রস্তাব দেয়।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, এভাবে আটকে রেখে নির্যাতনের মূল হোতা কুমিল্লার বাসিন্দা মাফিয়া শরীফ। মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের নতুন মাঠ গ্রামের সাকা মাতুব্বরের মেয়ে সুমিকে বিয়ে করেন শরীফ। সুমিসহ একাধিক দালাল মাদারীপুর সদর, শিবচর, কালকিনি, ডাসার, রাজৈর ও পাশের জেলা গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থেকে লোক সংগ্রহ করে লিবিয়ায় পাঠায়। লিবিয়ায় যারা নির্যাতন করে, তাদেরই একজন আজিজুল ইসলাম নির্ঝর (২৭)। তিনি মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের চরনাচনা গ্রামের আবুল কালাম হাওলাদারের ছেলে। তিনি লিবিয়ায় পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর জোয়ারা ক্যাম্পের মাফিয়া শরীফ হোসেনের সহযোগী। তার দায়িত্ব বন্দিদের নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করা। ভুক্তভোগীদের প্রথমে ঝুলানো হয় লোহার আঁড়ার সঙ্গে। এরপর প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় বেধড়ক মারধর করা হয়। নির্যাতন করার জন্য নির্ঝরকে শরীফ প্রতি ঘণ্টায় দিতেন ৩০ হাজার টাকা। মুক্তিপণের টাকার জন্য নির্ঝর ছাড় দেননি তার এলাকাসহ আশপাশের সাত-আট যুবককেও। তারা হলেন ছিলারচর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর মোড়ল কান্দির নুরুল হক মোড়লের ছেলে নাসিম মোড়ল, রেজাউল মোড়লের ছেলে রানা ইসলাম, মুজ্জাফার মোড়লের ছেলে শাহ আলম মোড়ল, রহিম মোড়লের ছেলে শফিকুল, আমিন উদ্দীন হাওলাদারের ছেলে সরোয়ার হাওলাদারসহ বেশ কয়েকজন। বর্তমানে রাজৈর ও মুকসুদপুরের একাধিক দালালের খপ্পরে পড়ে শরীফের ক্যাম্পে বহু যুবক বন্দি আছেন।
সদর উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামের ভুক্তভোগী রাকিব ফরাজী বলেন, শরীফের ক্যাম্পে নির্ঝর আমাকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলেছিল। জ্ঞান ফেরার পর আবারও মেরেছে। মারার ফলে আমার চোখের মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। ক্যাম্পে থাকার দুই মাসের মধ্যে নির্ঝরের নির্যাতনে ২ যুবক মারা গেছে।
আরেক ভুক্তভোগী ডাসার উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বনি আমিন। তাকে মুক্তিপণের জন্য কয়েক দফায় নির্যাতন চালানো হয়। পরে শরীফের স্ত্রী সুমির এজেন্ট ব্যাংকিং নম্বরে ২০ লাখ টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মুন্সীগঞ্জের মোল্লাকান্দি গ্রামের সেলিম শেখের ছেলে জাহাঙ্গীর শেখকেও (২৭) নির্যাতন করা হয়। শরীফের বন্দিশালায় তাকেও নির্যাতন করেন নির্ঝর। তিনি ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন লিবিয়ায়। সেখানে বন্দিশালায় এমন বিভীষিকাময় জীবন কেটেছে তার। পরে টাকার বিনিময়ে মুক্ত হয়ে হাইতেম নামের এক দালালের মাধ্যমে ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল পৌঁছেছেন ইতালিতে। দীর্ঘদিন ইতালির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। জাহাঙ্গীর বলেন, নির্ঝর এতটাই নির্দয়, কাউকেই ছাড়ত না। বাপ-চাচার বয়সিদেরও টাকার জন্য প্রচুর মারধর করত। গলায় পাড়া দিয়ে, দাড়ি টেনে কাঠের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নির্যাতন চালাত। আমাকে নির্যাতন করা দেখে বাবা স্ট্রোক করে মারা গেছেন। প্রশাসনের কাছে আমরা এর বিচার চাই।
সম্প্রতি বাংলাদেশে নিজ বাড়িতে ফিরেছেন অভিযুক্ত আজিজুল হক নির্ঝর। মুক্তিপণের দাবিতে নির্যাতনের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি নিজেও কাজের সন্ধানে লিবিয়া গিয়েছিলাম। আমাকে ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়ারা বন্দি করে শরীফের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পের বন্দিরা সবাই অনেক কান্নাকাটি আর চ্যাঁচামেচি করত। আমি ভাষা জানতাম বলে শরীফ আমাকে ক্যাম্পের দায়িত্ব দিয়েছিল সবাইকে চুপচাপ রাখার। সে সময় অনেককেই গালাগালি করেছি তাই হয়তো ক্ষুব্ধ হয়ে আমার নামে অভিযোগ দিতে পারে। আমি কারও কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করিনি। তবে শুনেছি ওখানে সাড়ে ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়। কেউ যদি আমার নামে অভিযোগ করে থাকে সেটা সত্য নয়।
মাদারীপুরে এ দালালচক্রের আরেক সদস্য সদরের কুনিয়া ইউনিয়নের তেরভাগদি গ্রামের বেলায়েত হোসেন। বেলায়েতের দায়িত্ব বিভিন্ন এলাকার যুবকদের প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাঠানো। বেলায়েত কিছুদিন আগে মানব পাচার মামলায় গোয়েন্দা সংস্থা সিটিটিসির হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। জামিনে এসে আবার সেই কাজে লিপ্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি ওই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইসমাইল মাস্টারের ছোট ছেলে। এ ব্যাপারে জানতে ২৯ ডিসেম্বর রাতে তাকে না পেয়ে তার স্ত্রী লাকী আক্তারকে ফোন দেওয়া হয়। বেলায়েতকে চাইলে তিনি তার শ্বশুর ইসমাইল মাস্টারকে ধরিয়ে দেন। ছেলের ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে তিনি পরে বলবেন বলে জানান।
এ ব্যাপারে জানতে লিবিয়ায় অবস্থানরত শরীফের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি তা ধরেননি। খুদে বার্তারও জবাব দেননি। তার স্ত্রী ও পরিবারের লোকজন মাসখানেক এলাকাছাড়া।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। আমরা মানব পাচারকারীদের গ্রেফতারে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি। এর আগে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছি।
