Logo
Logo
×

শেষ পাতা

কর্মকর্তাদের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত

লাভের ঢাকা-বরিশাল রুটে বিমানের বিদায়ঘণ্টা

সুবিধা পাচ্ছে বেসরকারি এয়ারলাইন্স

Icon

আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

লাভের ঢাকা-বরিশাল রুটে বিমানের বিদায়ঘণ্টা

‘আমরা তো বিমানে ওঠার জন্য ঢাকা যাই না, ঢাকা যাওয়ার জন্য বিমানে উঠি। এখানে বিমান যা করছে তাতে মনে হয় মানুষ তাদের কাছে দায় ঠেকেছে। সপ্তাহে ৩ দিন চালাছে ফ্লাইট তাও দুপুর বেলা অফ টাইমে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নগরী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত যাত্রী পরিবহণ সার্ভিস। প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের তুলনায় ভাড়াও বেশি নেবে। এভাবে করলে মানুষ কেন বিমানে উঠবে? নাকি তারাই চান না যে যাত্রী উঠুক?’ ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা-বরিশাল আকাশ পথের নিয়মিত যাত্রী গোলাম কবির। রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাংলাদেশ বিমানে না উঠে কেন বেসরকারি এয়ারলাইন্সে যাতায়াত করছেন জানতে চাইলে এভাবেই নিজের মতামত ব্যক্ত করেন তিনি।

শুধু গোলাম কবির নন, আকাশ পথে ঢাকা-বরিশাল রুটের নিয়মিত যাত্রীদের অধিকাংশই বাংলাদেশ বিমানের আচরণে ক্ষুব্ধ। সেবা প্রশ্নে বিমানের বিরূপ আচরণের কারণে এই রুটে বেসরকারি এয়ারলাইন্সের কাছে যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়ছে এমন অভিযোগও তাদের। এসব অভিযোগের সত্যতা মেলে বিমানের গত কয়েক মাসের বিতর্র্কিত নানা সিদ্ধান্তে। গত বছরের আগস্টে হঠাৎ করেই ঢাকা-বরিশাল রুটে চলমান দৈনিক ফ্লাইট থেকে সরে এসে সপ্তাহে ৩ দিন সার্ভিস দেওয়া শুরু করে বিমান। তাও আবার ফ্লাইটের সময়সীমা নির্ধারণ হয় দুপুরে। যোগাযোগ করলে বিমানের পক্ষ থেকে পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী কমার অজুহাত দেওয়া হয়। এই অজুহাতে বিমান তাদের ফ্লাইট কমালেও দৈনিক যাত্রী পরিবহণ অব্যাহত রাখে বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস বাংলা। তাদের ফ্লাইট পরিচালনার সময়সূচিও রাখা হয় যাত্রীবান্ধব সময়ে।

বরিশাল এয়ারপোর্ট সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, পদ্মা সেতু চালুর পর প্রথম ২-৩ মাস যাত্রীর সংখ্যা খানিকটা কমলেও পরে আবার তা মোটামুটি ঠিক হয়ে যায়। বিমানবন্দরে যাত্রী ওঠানামার হিসাব অনুুযায়ী, সেতু চালু হওয়ার আগে এই বন্দর ব্যবহার করে মাসে ১০ হাজারের মতো যাত্রী আসা-যাওয়া করত ঢাকা-বরিশাল রুটে। সেতু চালুর পর প্রথমদিকে তা কমে ৮ হাজারে এলেও পরে বেড়ে সম্প্রতি আবার ৯ হাজারের ওপরে দাঁড়িয়েছে। যাত্রী চলাচল বাড়লেও পাল্টায়নি বিমানের জেগে ঘুমোনোর পরিস্থিতি। তারা এখনও সপ্তাহে ৩ দিন এবং দুপুর বেলার সার্ভিসেই রয়েছে। ফলে কমছে তাদের যাত্রী।

বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা-বরিশাল রুটে বিমান চলাচল করে দুপুরে। এটা দিনের একেবারে মাঝামাঝি সময়। ফলে ঢাকা যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে বিমানের ওপর নির্ভর করলে একদিকে যেমন পুরো দিনটাই নষ্ট হয় তেমনি দুপুর বেলা ঢাকায় গিয়ে অফিস/আদালতের কাজকর্ম করাও সম্ভব হয় না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে অধিকাংশ মানুষ বিমানে উঠে জরুরি ভিত্তিতে গন্তব্যে যাওয়ার প্রয়োজনে। সেখানে সপ্তাহে ৩দিন ফ্লাইট দিয়ে বিমান নিজেই নিজেকে যাত্রীদের কাছে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলেছে। মানুষ তো আর বিমানের সময় ধরে গন্তব্যে যাবে না। যাবে তার নিজের প্রয়োজন ও সময়ে। বিমান যেভাবে তাদের শিডিউল নির্ধারণ করছে সেটা মোটেই যাত্রীবান্ধব নয়। দৈনিক সার্ভিস যখন চালু ছিল তখন বরিশাল নগরী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাত্রী পরিবহণের একটি মাইক্রোবাস ছিল বিমানের। সপ্তাহে ৩ দিন সার্ভিস চালুর পর সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে তারা নিজেরাই চাইছে যাতে যাত্রী না ওঠে। এভাবে চলার একপর্যায়ে বলবে যাত্রী সংকটের কারণে বন্ধ করে দেওয়া হল ঢাকা-বরিশাল রুটের বিমান।’

বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি নাট্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কিছুদিন পর ঢাকা-বরিশাল রুটে সার্ভিস বন্ধ করে নভো এয়ার। তখন ফলাও করে প্রচার করা হয় যাত্রী সংকটের কারণে তারা ফ্লাইট বন্ধ করেছে। নিজেদের ফ্লাইট কমানোর অজুহাতকে বৈধতা দিতে বিমানের কর্তা-ব্যক্তিরা তখন বারবার মিডিয়ার কাছে এটিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে। অথচ নেপথ্যের ঘটনা ছিল ভিন্ন। এয়ারক্র্যাফট সংকটের কারণে ফ্লাইট বন্ধ করেছিল নভো। সমস্যা মিটে যাওয়ায় আগামীকাল (১ মার্চ) থেকে আবার ঢাকা-বরিশাল রুটে ফ্লাইট চালু করছে তারা। এখানে লক্ষণীয় যে, নভো সপ্তাহে ওই ৩ দিন ফ্লাইট চালাবে যে ৩ দিন বিমানের ফ্লাইট নেই।’

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে নভো এয়ারের একটি সূত্র জানায়, ‘ইউএস-বাংলা ফ্লাইট চালাচ্ছে বিকালে। বিমান চালাচ্ছে সপ্তাহে ৩ দিন। জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে দাপ্তরিক প্রয়োজনসহ নানা কারনে দিনের প্রথমভাগে ঢাকাগামী যাত্রীদের বেশ বড় একটা চাপ থাকে বরিশালে। কিন্তু নিয়মিত ফ্লাইট না থাকায় এরা সড়ক পথে ঢাকা যায়। এসব দিক হিসাব করেই ঢাকা-বরিশাল রুটে ফিরছে নভো এয়ার। পরিস্থিতি অনুকূল হলে দৈনিক ফ্লাইট পরিচালনার চিন্তা ভাবনাও রয়েছে আমাদের।’

অসময়ে পরিচালনা আর ফ্লাইট সংখ্যা কমানোই কেবল নয়, পায়ে কুড়াল মারার আরও বড় আয়োজন করেছে বিমান। বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো যেখানে ঢাকা-বরিশাল রুটে ভাড়া কমাচ্ছে সেখানে বর্তমানের তুলনায় আরো ২শ’ টাকা বাড়াচ্ছে বিমান। এই রুটে সাড়ে ৩ হাজারের স্থলে ৫শ’ কমিয়ে ৩ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারন করেছে ইউএস-বাংলা। বুধবার থেকে সার্ভিসে আসা নভো এয়ার সর্বনিম্ন ভাড়া নেবে ২ হাজার ৮শ’। এর বিপরীতে উলটো পথে হেঁটে বর্তমানে বহাল ৩ হাজার টাকার ভাড়া ২শ’ বাড়িয়ে ৩ হাজার ২শ’ টাকা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিমান।

নৌ ও আকাশ পথে যাত্রী পরিবহণ গবেষক নাসিম উল আলম বলেন, ‘এই রুটে বিমান যা করছে তার সবটাই আত্মঘাতী। অথচ ঢাকা-বরিশাল এয়ার রুট ডমেস্টিক প্রশ্নে দেশের অন্য যে কোন রুটের চেয়ে লাভজনক। এখানে মাত্র ৬১ অ্যারোনটিক্যাল মাইল পাড়ি দিয়ে কখনো কখনো ঢাকা-কলকাতা রুটের সমান ভাড়াও নেয় এয়ারলাইন্সগুলো। যাত্রী চাপের মুহূর্তে ওয়ানওয়ে একজন যাত্রীর কাছ থেকে ১০ হাজার ৬শ’ টাকা পর্যন্ত ভাড়া নেওয়ার রেকর্ডও রয়েছে। এরকম লাভজনক রুটে যেখানে নতুন করে সার্ভিস শুরু করল নভো এয়ার, বিকালে দৈনিক ফ্লাইটের পাশাপাশি সকালেও ফ্লাইট চালানোর চিন্তা করছে ইউএস-বাংলা, সেখানে বিমান কেন একের পর এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তার তদন্ত হওয়া দরকার। যারা বিমান চালায় তারা নিশ্চই এতটা বোকা নয় যে একের পর এক যাত্রী না ওঠার মতো সিদ্ধান্ত নিতে থাকবে। বিমানের এসব আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের লাভ ঘরে তুলছে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে। তদন্ত করলেই তা বেরিয়ে আসবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের পরিচালক (অ্যাডমিন-মার্কেটিং-সেলস) সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এয়ারক্র্যাফট এবং ক্রু সংকটের কারণে আমরা কিছুটা জটিলতায় আছি। এসব সমস্যা কেটে গেলে ঢাকা-বরিশাল রুটে বিমানের সার্ভিস পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার ভাবনা রয়েছে।’ সপ্তাহে মাত্র ৩টি ফ্লাইট এবং ফ্লাইটের সময়সূচির কারণে যাত্রী হারানোর বিষয়টি স্বীকার করে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম বলেন, ‘বরিশাল সেক্টর নিয়ে ইতিবাচক কিছু করার চেষ্টা আছে। যেভাবে এখন ফ্লাইট চলছে তাতে যাত্রী হারানোর বিষয়টিও মিথ্যা নয়। আমরা খুব শিগগরিই এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব বলে আশা করছি।’

বিমান

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম