মূল লক্ষ্য পূরণ প্রশ্নের মুখে
কাজ শেষ না করেই সমাপ্ত ১৮৬ প্রকল্প
আইএমইডি’র প্রতিবেদনের তথ্য: অর্থ ও সময় অপচয় * দুর্নীতির হাতিয়ার হিসাবে প্রকল্পকে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে -ড. জাহিদ হোসেন
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শতভাগ কাজ শেষ না করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে ১৮৬টি উন্নয়ন প্রকল্প। শুধু তাই নয়, এগুলোর কোনোটির আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি সাড়ে ৩ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ঘটেছে এমন ঘটনা। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি ১ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে উপস্থাপন করে সংস্থাটি।
এদিকে রাজনৈতিক বিবেচনা, জাতীয় সংসদ-সদস্যদের ব্যক্তিগত চাহিদা কিংবা সম্ভাব্যতা ও প্রয়োজনীয়তা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ করায় এমনটি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে প্রকল্প গ্রহণ এবং শেষ করাটা অর্থ ও সময় উভয়েরই অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এরকম ঘটনা ঘটলে অবশ্যই সেটি অপচয়। এখানে যদি এমন হয় যে, প্রকল্প সিলেকশনে ত্রুটি ছিল, পরে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা মনে করলেন ভুল না বাড়িয়ে এখানেই শেষ করে দিই; তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে-শুরুতেই কেন এটা ভাবা হয়নি।
এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, এসব প্রকল্পের ক্ষেত্রে আইএমইডিকে গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত কেন এমন ঘটনা ঘটছে।
এক্ষেত্রে দেখতে হবে বিশেষ কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভগের ক্ষেত্রে এমন প্রবণতা ধারাবাহিকভাবে চলছে কি না। দেখতে হবে এভাবে দুর্নীতির হতিয়ার হিসাবে প্রকল্পকে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না। অর্থাৎ প্রকল্প হাতে নিয়ে গাড়ি ক্রয়, বিদেশ ভ্রমণ, আত্মীয়স্বজনকে চাকরি দেওয়া প্রভৃতি করা শেষে বলা হলো আর প্রকল্প দরকার নেই। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত অর্থবছর মোট ১ হাজার ৮৩৬টি উন্নয়ন প্রকল্প ছিল। এর মধ্যে ৩৫৫টি প্রকল্প গত বছর জুনের মধ্যেই সমাপ্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২৯৪টি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়া ওই অর্থবছরে সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত ছিল না এমন ৪২টি প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এতে মোট বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩৬টিতে। তবে এসবের মধ্যে শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে-এমন প্রকল্প রয়েছে ১৫০টি। বাকি ১৮৬টি প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ না করেই সমাপ্ত করা হয়েছে।
শনিবার মোবাইল ফোনে যোগোযোগ করা হয় আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কেন এসব প্রকল্প শতভাগ কাজ না করেই সমাপ্ত করা হয়েছে, সেটি এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে এটুকু বলতে পারি, আগামী প্রতিবেদন তৈরির সময় এ ধরনের ঘটনার বিস্তারিত কারণ খুঁজে দেখা হবে।
তিনি আরও বলেন, এখন আমাদের কাছে নির্দেশনা আছে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া কোনো বড় প্রকল্প নেওয়া হবে না। সেই সঙ্গে কোনো প্রকল্পে যদি ভূমি অধিগ্রহণ থাকে, তাহলে আগেই ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। তারপরই মূল প্রকল্প নিতে হবে, যাতে ভূমি জটিলতার কারণে কোনো প্রকল্প বিলম্বিত বা কোনো সমস্যা না হয়।
আইএমইডিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিবছর এডিপিতে একই ঘটনা ঘটছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে কাজ বাকি রেখেই সমাপ্ত ঘোষিত প্রকল্প সংখ্যা ছিল ১২৪টি। ওই অর্থবছরে মোট বাস্তবায়ন হয় ২৬৪টি প্রকল্প। এর মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল ১৪০টি প্রকল্প। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে শতভাগ কাজ শেষ না করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় ৯২টি প্রকল্প।
সেসময় মোট বাস্তবায়ন হয়েছিল ১৮২টি প্রকল্প। এর মধ্যে শতভাগ কাজ সম্পন্ন হওয়া প্রকল্প ছিল ৯০টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কাজ অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত করা হয় ১৫৭টির। ওই অর্থবছরে মোট বাস্তবায়ন করা হয় ৩১২টি প্রকল্প। এর মধ্যে শতভাগ করা হয়েছিল ১৫৫টির। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিন বছরের তুলনায় গত অর্থবছরে এমন অসমাপ্ত প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণার সংখ্যা বেড়েছে।
আইএমইডি ও পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, এরকম ঘটনা ঘটে থাকলে সেক্ষেত্রে প্রকল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাহত হওয়ার কথা। মাঝপথে প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করার যৌক্তিক কারণ খুঁজে বের করাটা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং আইএমইডির দায়িত্ব।
কাজ অসমাপ্ত রেখেই যদি প্রকল্প সমাপ্ত করতে হয়, তাহলে সেটি যদি একনেকে অনুমোদন হয়েই থাকে, সেক্ষেত্রে একনেককে গোচরীভূত করা উচিত ছিল। আমি দায়িত্ব পালনের সময় নর্থবেঙ্গল সুগার মিল এবং অন্য আরেকটি প্রকল্প মাঝপথে সমাপ্ত করার ক্ষেত্রে একনেকের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরেছিলাম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামান্য কাজ করেই সমাপ্ত করা হয়েছে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি ফর এক্সপোর্ট কমপিটিটিভনেস অব অ্যাগ্রো প্রডাক্ট অ্যাট জুট গুডস বাংলাদেশ’ প্রকল্পটি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এছাড়া আর্থিক অগ্রগতি আরও কম, অর্থাৎ ৩ দশমিক ২২ শতাংশ। এটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অর্থবছর শেষে খরচ হয়েছিল ১৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। মেয়াদ ধরা ছিল ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত। কিন্তু সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় ২০২২ সালের জুনে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শনিবার কোনো মন্তব্য করেননি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা সেলের প্রধান অতিরিক্ত সচিব মো. মোশারফ হোসেন। তার মন্ত্রণালয়ের আরও প্রকল্পের শতভাগ অগ্রগতি ছাড়াই কেন সমাপ্ত করা হয়েছে-এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে আমি মুখস্থ কিছুই বলতে পারব না। প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) সঙ্গে কথা বলেন।
এছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘আরলি লার্নিং ফর চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (থার্ড ফেজ)’ শীর্ষক প্রকল্পে। এটির বাস্তব ও আর্থিক অগ্রগতি যথাক্রমে ৪১ এবং ৩৯ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ৩৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা হলেও খরচ হয়েছিল ১৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
এছাড়া ‘কনস্ট্রাকশন অব রেসিডেন্টাল ফ্ল্যাটস অ্যাট জি ব্লক অব হালিশহর হাউজিং স্টেট ইন চিটাগং’ শীর্ষক প্রকল্পের বাস্তব ও আর্থিক অগ্রগতি যথাক্রমে ৩৭ ও ১৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ অবস্থায়ই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
এ তালিকায় আরও আছে এমন কয়েকটি প্রকল্প হলো-বিকেএসপির সিলেট ও দিনাজপুর আঞ্চলিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে সিনথেটিক হকি টার্ফ তৈরি, ‘ইমপ্রুভমেন্ট অব উইমেন অ্যাবিলিটি টু পার্টিসিপের্ট ইন প্রডাকটিভ পটেনশিয়াল অ্যাকশন’, ‘ডেভেলপমেন্ট অব বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়াম অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন অব ইনডোর স্টেডিয়াম অ্যাট কক্সবাজার’ এবং ঢাকা ওয়াসার হাজারীবাগ, কুর্মিটোলা, মান্ডা ও বেগুনবাড়ী খালে জমি অধিগ্রহণ প্রকল্প। এছাড়া ঢাকা সিটির নালা-নর্দমা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, ড্রেন ও ফুটপাত উন্নয়ন-সংস্কার প্রকল্প শতভাগ কাজ ছাড়াই সমাপ্ত করা হয়েছে।
