Logo
Logo
×

শেষ পাতা

২০ মিনিটে মাওয়া প্রান্তে পৌঁছল ট্রেন

স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে আরেক মাইলফলক

এবার পূর্ণতা পেল পদ্মা সেতু -রেলমন্ত্রী

Icon

হাসিবুল হাসান, ভাঙ্গা (ফরিদপুর) ও মাওয়া (মুন্সীগঞ্জ) থেকে ফিরে

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে আরেক মাইলফলক

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছে। মঙ্গলবার সেতুটি দিয়ে পরীক্ষামূলক বিশেষ ট্রেন চলে। গত বছর ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রায় ৯ মাস পর মাইলফলক রচিত হয়। পদ্মা পারের মানুষের আরেকটি স্বপ্ন জয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের ৬৬২১ নম্বর ইঞ্জিন পরিচালিত পাঁচটি বগিবিশিষ্ট ট্রেনটি ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন থেকে ৪২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পৌঁছে। ট্রেনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার। এর মাধ্যমে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রেন চলল।

দুপুর ১টা ৫ মিনিটে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন উৎসবমুখর পরিবেশে ভাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনে রেলযাত্রার উদ্বোধন করেন। ভাঙ্গা থেকে দুপুর ১টা ২১ মিনিটে সাতটি বগিবিশিষ্ট বিশেষ ট্রেন মাওয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে। সেপ্টেম্বরে ভাঙ্গা থেকে ঢাকা পর্যন্ত ট্রেনটি চলাচলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর নিচে রেল এবং উপরে গাড়ি চলাচলের জন্য নির্ধারিত। গত বছর ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক অংশের উদ্বোধন করেন। পরদিন ২৬ জুন থেকে সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়।

পরীক্ষামূলক চলাচল উদ্বোধনের পর আমেরিকার তৈরি ইঞ্জিন আর চীনের তৈরি বিশেষ ট্রেন ভাঙ্গা থেকে মাওয়া প্রান্তের উদ্দেশে যাত্রা করে। ট্রেনটির চালকের আসনে ছিলেন রেলওয়ের লোকোমোটিভ মাস্টার (এএলএম) রবিউল আলম। ট্রেনে রেলমন্ত্রী এবং আমন্ত্রিত অতিথিসহ বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষার্থী, যুব সমাজের প্রতিনিধিসহ তিন শতাধিক যাত্রী ছিলেন। ট্রেনটির সামনে ছিল ‘গ্যাংকার’। সেখানে অস্থায়ী চেয়ারে সংবাদকর্মীদের বসার ব্যবস্থা ছিল। এদিকে ভাঙ্গা স্টেশন থেকে সেতু পর্যন্ত রাস্তার দুই পারে ছিল উৎসুক মানুষের ভিড়। পদ্মা সেতুতে ওঠা প্রথম ট্রেন দেখতে কৌতূহলী নারী-পুরুষ-শিশুরা ট্রেনের হুইসেলের শব্দে রেললাইনের পাশে ছুটে আসেন। হাত নেড়ে, চিৎকার করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তারা। এ সময় কেউ কেউ ট্রেনের ভিডিও করেন, কেউ ট্রেনের সঙ্গে সেলফি তোলেন। স্কুল ছেড়েও শিক্ষার্থীরা রেললাইনের পাশে দাঁড়ায়। শিশুদের কেউ কেউ ট্রেনের সঙ্গে ছুট দেয়। বাড়ির আঙিনা বা বারান্দা থেকেও অনেকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানায়। এ সময় পুরো এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে ট্রেনটি জাজিরায় পদ্মা স্টেশন দিয়ে যাওয়ার সময় কর্মীরা বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা হাতে ট্রেনটিকে স্বাগত জানায়।

ভাঙ্গা স্টেশন থেকে মাওয়া স্টেশন পর্যন্ত দূরত্ব সাড়ে ৪১ কিলোমিটার। দুপুর ২টা ৪৮ মিনিটে ট্রেনটি খুব ধীরগতিতে পদ্মা সেতুর নিচের ডেকে প্রবেশ করে। এ সময় ট্রেনের ভেতরে দেশাত্মবোধক গান চলছিল। পরীক্ষামূলক যাত্রায় দুই ঘণ্টায় এ পথ অতিক্রম করে ট্রেনটি। তবে শুধু মূল সেতু পাড়ি দিতে সময় লাগে প্রায় ২০ মিনিট। ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ছিল ৩০ কিমি.। তবে গড়ে ২০ কিমি. গতিতে চলেছে ট্রেনটি। ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পর্যন্ত চারটি স্টেশন ও একটি জংশন স্টেশন চোখে পড়ে। এগুলো হলো-ভাঙ্গা স্টেশন, ভাঙ্গা জংশন স্টেশন, শিবচর স্টেশন, পদ্মা স্টেশন ও মাওয়া স্টেশন। স্টেশনগুলো এখনো নির্মাণাধীন। সেখানকার শ্রমিক ও কর্মকর্তারা পতাকা উড়িয়ে ট্রেন যাত্রীদের স্বাগত জানায়। পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের ৪২ নম্বর ও মাওয়া প্রান্তের ১ নম্বর পিয়ারে আতশবাজি ফাটিয়ে ট্রেনকে স্বাগত জানানো হয়।

ট্রেনের যাত্রা শুরুর আগে ভাঙ্গা স্টেশনে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার স্বপ্ন একটা একটা করে বাস্তবায়ন করছেন। সেপ্টেম্বরে ভাঙ্গা থেকে ঢাকা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে। এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা রেলকে যশোর পর্যন্ত নিয়ে যাব। তবে এজন্য ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ সময় পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ব্রিগেডিয়ার সাইদ আহমেদ বলেন, প্রকল্পের কাজ শুরু করতে আমাদের ৩ মাস দেরি হয়েছিল। এরপরও সময়মতো কাজ শেষ করতে পারায় আমরা আনন্দিত। এরইমধ্যে আমাদের এ অংশের কাজের ৯২ ভাগ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ প্রকল্প মেয়াদের মধ্যে শেষ হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, সংসদ-সদস্য ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, ইকবাল হোসেন অপু, নাহিম রাজ্জাক, মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন, সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি। এছাড়া ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন, পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান উপস্থিত ছিলেন।

এরপর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া স্টেশনে পৌঁছে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, এ ট্রেন চলার মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু পূর্ণতা পেল। তিনি আরও বলেন, আশা করা হচ্ছে-এ বছরই ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেলপথে ট্রেন চলবে। আগস্টের মধ্যে এ অংশের কাজ শেষ হবে। সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। আগামী বছর যশোর পর্যন্ত রেল চলবে।

মাদারীপুর-১ আসনের এমপি ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর ই আলম চৌধুরী বলেন, পদ্মা সেতুতে ট্রেন চালু হওয়ার পর ব্যবসা বাণিজ্যে আরও প্রসার ঘটবে। অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠবে। সামাজিক বিপ্লব হবে। অথনৈতিক দিক থেকে মাইলফলক হবে।

শরীয়তপুর-২ আসনের এমপি ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বলেন, সড়কপথে যানজট সৃষ্টি হলেও রেলপথে যানজট হয় না। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য পরিবহণ ও কম খরচে তাড়াতাড়ি যাওয়াতের ব্যবস্থা হবে।

মাদারীপুর-৩ আসনের এমপি ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ব্যাপক উন্নয়ন শুরু হয়েছে। পর্যটন খাত, শিল্প খাত ব্যাপকভাবে প্রসারিত হচ্ছে। আমরা রেললাইনকে হযরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত চালু করার দাবি জানাই। মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের এমপি সাগুফা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, রেলে অনেক মানুষ একসঙ্গে যেতে পারে। খরচও তুলনামূলক কম। এ ব্যবস্থার দ্বার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা খুলে দিয়েছেন। শরীয়তপুর-১ আসনের এমপি ইকবাল হোসেন অপু বলেন, আমরা কখনো ভাবিনি পদ্মার উপর দিয়ে সেতু হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা স্বপ্ন দেখিয়েছেন, বাস্তবায়নও করেছেন। দক্ষিণ বাংলার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। সেতু হওয়ার পর জাজিরার সবজি বিদেশ যায়। ট্রেন চালু হওয়ার পর মানুষ কম খরচে খুব সহজে চলাচল করতে পারবে। ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন বলেন, আমরা প্রথম ট্রেনে পদ্মা পার হচ্ছি। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। শরীয়তপুর-৩ আসনের এমপি নাহিম রাজ্জাক বলেন, রেল সংযোগে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ বিপ্লব হবে।

লোকোমোটিভ মাস্টার (এএলএম) রবিউল আলম বলেন, সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে জানায়। এরপর থেকে দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। এটি তার জীবনে অনেক বড় পাওয়া। তিনি আরও বলেন, সোমবার রাতে বিশেষ ট্রেনটি সৈয়দপুর থেকে ঈশ্বরদী, পোড়াদহ, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর হয়ে ভাঙ্গা স্টেশনে নিয়ে আসেন তিনি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম