Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা বাবরের হুমকি

‘ইজ্জত কইরা ৪/৫ বার বলছি এইবার উপযুক্ত শাস্তি’

রেলওয়ের টেন্ডার বাণিজ্য: ইজিপির যুগেও উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানে বাধ্য করছে বাবর সিন্ডিকেট * ৬% চাঁদা না দেওয়ায় ঠিকাদারের ওপর হামলা * ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ভুক্তভোগীদের আবেদন

Icon

মাহবুব আলম লাবলু

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘ইজ্জত কইরা ৪/৫ বার বলছি এইবার উপযুক্ত শাস্তি’

বাবর : (উত্তেজিত কণ্ঠে) আপনার পোলা গিয়া শিডিউল টানতাছে। দরখাস্ত দিতাছে। একজনের কাজ আরেকজন টানাটানি করা দরকার আছে। পুরো বাংলাদেশ ঠিক। শুধু আপনি আর আপনার পোলা বেঠিক। ঘটনা কী? আপনারে বাপ ডাইক্যা কইলাম, চাচা ডাইক্যা কইলাম। তারপরেও তো কাম অয় না।

ঠিকাদার : (কিছুক্ষণ চুপ)... তো বিষয়টা কী?

বাবর : বিষয়টা হচ্ছে, পিগ আয়রনের টেন্ডার কেন করতে যাইবেন আপনি, আপনার পোলা?

ঠিকাদার : আরে আমি, আমার পোলা না-বাংলাদেশের যে কোনো একজন নাগরিকই তো করতে পারবে।

বাবর : তা তো পারবে। আপনি, আপনার পোলা সবগুলোতে বাঁ হাত ঢুকাইয়া দিবেন। শুধু শুধু মাস্তানি কইরে লাভ নেই। শোনেন, আপনি সব জায়গায় বাঁ হাত ঢুকাইয়েন না। বেইজ্জত হয়ে যাইবেন। বুড়াকালে ইজ্জত লন।

ঠিকাদার : আচ্ছা, ওকে, ফাইন। এখন কথা হলো যে, আমরা তো এখানে ব্যবসা করছি ফর দ্য লাস্ট ফরটি ইয়ারস।

বাবর : আপনি গোটা বাংলাদেশ নিয়া মাথা ঘামাইতে যান, পারবেন? যেইখানে-সেইখানে বাঁ হাত গলায় দিবেন। আপনি কি সব জাগাতে (জায়গায়) কমিশন খাইতে চান। না, কী করতে চান। আপনি কি বাঁ হাত গলানোর লোক। আপনার কি অত ক্যাপিটাল আছে সব কাজ করার। আপনারে ইজ্জত কইরা ৪/৫ বার বলছি। এইবার কিন্তু আপনাকে উপযুক্ত শাস্তি দিব।

ঠিকাদার : আচ্ছা দিয়েন।

মোবাইল ফোনে উল্লিখিত কথোপকথন হয়েছে রেলওয়ের টেন্ডার বাণিজ্যের অন্যতম নিয়ন্ত্রক যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত বর্তমানে কথিত আওয়ামী লীগ নেতা হিসাবে পরিচিত হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও এক ঠিকাদারের মধ্যে। কথোপকথনের চুম্বকাংশে ওই ঠিকাদারকে নানাভাবে হুমকি দিতে শোনা গেছে। তাদের কথপোকথনের পুরো রেকর্ড এসেছে যুগান্তরের হাতে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এই কথোপকথনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, বাবরের নির্দেশ অমান্য করে রেলওয়ের কাজের দরপত্র কিনতে চাইলে ঠিকাদারদের থাকতে হয় চরম আতঙ্কে। চট্টগ্রামের প্রভাবশালী তরুণ এক মন্ত্রীর আশীর্বাদ থাকায় প্রশাসন জেনেও বাবরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

হুমকি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ভুক্তভোগী ঠিকাদারের পরিবারের এক সদস্য বলেছেন, বাবর সরি বলায় ঘটনাটি আপাতত সুরাহা হয়েছে। হুমকির ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি করা আছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ট্রেড অ্যান্ড টেকনোলজির মালিক, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও ক্রীড়া সংগঠক এসএম ইকবাল মোর্শেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘ইজিপি টেন্ডারে অংশ নিয়ে সর্বনিু দরদাতা হিসাবে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৮৭ হাজার টাকা বরাদ্দে পিগ আয়রন সরবরাহের কাজ পায় আমার প্রতিষ্ঠান। এই কাজের জন্য আমার কাছে ৬ পার্সেন্ট চাঁদা দাবি করে বাবর। আমি তা দিতে অস্বীকার করায় পবিত্র শবেবরাতের দিন লিমনের উপস্থিতিতে বাবরের ক্যাডার বাহিনী আমাকে মারধর করে। ইজিপিতে কাজ পেয়ে বাবরকে কেন চাঁদা দেব।’

ভুক্তভোগী ঠিকাদাররা জানিয়েছেন, সিআরবিতে সংঘটিত জোড়া খুনসহ একাধিক মামলার আসামি বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর চট্টগ্রামের প্রভাবশালী এক তরুণ মন্ত্রীর অনুসারী। দলে পদ-পদবি না থাকলেও কথিত আওয়ামী লীগ নেতা হিসাবে সিআরবিতে প্রভাব খাটান। মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয়ে বাবরের প্রচারণাও চালাচ্ছে তার অনুসারীরা। আর জোড়া খুন মামলার আরেক আসামি ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতা সাইফুল আলম লিমন চট্টগ্রাম নগরের প্রভাবশালী সাবেক এক জনপ্রতিনিধির অনুসারী। অভিযোগ আছে, বাবর-লিমন রাজনৈতিকভাবে দুই নেতার মতাদর্শী হলেও সিআরবির টেন্ডার বাণিজ্যে তারা একাট্টা। দুজনেরই আলাদা ক্যাডার বাহিনী রয়েছে।

বাহিনীর সদস্যরা হলেন-অজিত দাস, ওসমান গনি দুলু, খুরশিদ আলম, ফারুক ই মঞ্জুর বাপ্পী, ছোটন বড়ুয়া, মাহবুব এলাহী, লিটন চৌধুরী রিংকু, ওমর ফারুক, শেখ ফরিদ, জহিরুল ইসলাম টিটু, তোতা মিয়া, টাকলু হানিফ, লম্বা আমজাদ ও সোহাগ। এদের নিয়ন্ত্রণে থাকে পুরো সিআরবি। টেন্ডার আহ্বানের পর বাবর-লিমনের অমতে কেউ দরপত্র কিনলেই বাহিনীর সদস্যরা জেনে যায়। এরপর মোবাইল ফোনে দেওয়া হয় হুমকি।

জানতে চাইলে হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর যুগান্তরকে বলেন, ‘ইজিপি টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। আমার কোনো অস্ত্রবাজ বাহিনী নেই। কেউ আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আনলে তাকে আদালতে প্রমাণ দিতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে মোবাইল ফোনে হুমকি দিইনি। চাঁদার দাবিতে কাউকে মারধরের তথ্যও ঠিক নয়।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাবর-লিমন সিন্ডিকেটের সঙ্গে সিআরবির অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। তাদের মাধ্যমে ইজিপি পাশ কাটিয়ে পুরোনো পদ্ধতিতে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমেও কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে বাবরের পছন্দের ঠিকাদাররা। গত বছরের ২৪ নভেম্বর প্রায় কোটি টাকা বরাদ্দে ১ হাজার ৭৬৭ পিস ব্রেক ব্লক (ট্রেনের লোহার ব্রেকসু) সরবরাহ কাজের ওপেন টেন্ডার আহ্বান করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর দরপত্র বিক্রি শেষ এবং ১৯ ডিসেম্বর দরপত্র বাক্স খোলার দিন নির্ধারিত ছিল। কন্ট্রোলার অব স্টোর ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ারুল ইসলামের সই করা টেন্ডার বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে শুধু কন্ট্রোলার অব স্টোরস অফিসে সরাসরি গিয়ে দরপত্র কেনা ও জমা দেওয়া যাবে।

সাধারণত ওপেন টেন্ডারে সংশ্লিষ্ট অফিসের বাইরে নিরাপদ আরও অন্তত দুটি স্থানে টেন্ডার বাক্স বসিয়ে দরপত্র জমা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই টেন্ডারের ক্ষেত্রে কন্ট্রোলার অফিসের বাইরে অন্য কোথাও দরপত্র বিক্রি ও জমা নেওয়া হয়নি। এই সুযোগে প্রভাব খাটিয়ে বাবর তার পছন্দের ঠিকাদার বাচ্চুকে এই কাজ পাইয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা কমিশন তুলে নেন বলে অভিযোগ আছে। বাবর সিন্ডিকেটের বাইরে অতিগোপনে একজন ঠিকদার দরপত্র কিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু জমা দেওয়ার সময় বাবরের ক্যাডার বাহিনী ওই ঠিকাদারকে লাঞ্ছিত করে দরপত্র কেড়ে নেয়।

ঠিকাদারদের অভিযোগ, ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ারুল ইসলাম বাবর সিন্ডিকেটে জড়িয়ে টেন্ডার বাণিজ্য থেকে ফায়দা লুটছেন। এতে সরকারি অর্থেরও অপচয় হচ্ছে। উদাহরণ তুলে ধরে তারা বলেন, প্রতিটি ব্রেক ব্লকের বাজারমূল্য সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা। কিন্তু টেন্ডারে প্রতিটির দর নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার টাকা। বেশি দরে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে কমিশনের টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করে নেন বাবর ও তার সহযোগীরা।

অভিযোগ অস্বীকার করে ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ারুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে ইজিপি টেন্ডার আহ্বান করা যায়নি। আর কন্ট্রোলার অফিসের বাইরে টেন্ডার বাক্স বসাতে গেলে ডিজি সাহেবের অনুমতি লাগে। তাই অন্য কোথাও টেন্ডার বাক্স বসানো যায়নি।’ বাববের দাপটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেখার বিষয়। তার সম্পর্কে আপনারা যেমন শোনেন, আমরাও তেমন শুনি।’

টেন্ডার বাণিজ্যের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে লিমন গ্রুপের প্রধান বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল আলম লিমন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি রেলের ছোটখাটো ব্যবসা করি। আমার কোনো বাহিনী নেই। কোনো ঠিকাদারকে মারধরের সঙ্গেও আমি সম্পৃক্ত নই। বাবর ভাইয়ের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে। অন্য কোনো সম্পর্ক নেই।’

এদিকে বাবরের অপকর্ম তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে স্বরাষ্ট্র ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ে আবেদন জমা দিয়েছেন চার ঠিকাদার। আবেদনে বলা হয়েছে, বাবরের অস্ত্রবাজ বাহিনীর দাপটে চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিংয়ে (সিআরবি) কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদাররা জিম্মি। ইজিপি টেন্ডারের যুগেও এই সিন্ডিকেটের দাপট ও অস্ত্রবাজদের হুমকিতে সাধারণ ঠিকাদাররা দরপত্র জমা দিতে সাহস পান না। কেউ দরপত্র কেনামাত্র সেই তথ্য বাবর বাহিনীর কাছে চলে যায়। আবেদনে আরও বলা হয়েছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে রেল সিন্ডিকেটের হোতা বাবর বাহিনীর দৌরাত্ম্য বন্ধ করা না গেলে সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হবে। দ্রুত বাবর ও তার বাহিনীর অস্ত্রবাজদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন আবেদনকারীরা।

আবেদনকারী ঠিকাদারদের একজন স্বাধীন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী নূর মোহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, ‘ইজিপিতে কাজ পেলেও বাবরকে ৬-৮% চাঁদা দিতে হয়। তাই বাবর ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছি। বাবরের দাপটে ঠিকাদাররা অসহায়।’

উপযুক্ত শাস্তি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম