সংসদ নির্বাচন: মেহেরপুর
আওয়ামী লীগের ঘরেই শত্রু বিএনপির প্রার্থীরা কোণঠাসা
তোজাম্মেল আযম, মেহেরপুর
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মেহেরপুরের দুটি আসনেই চরম বিরোধে জড়িয়ে আছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। দলীয় কোন্দলসহ নানা ইস্যুতে নিজেরাই নিজেদের শত্রুতে পরিণত হয়েছেন তারা।
বিভেদ এমন পর্যায়ে আছে, দুটি আসনেই এবার দলীয় মনোনয়ন যাকেই দেওয়া হোক-বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুটি আসনেই সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন নৌকার সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
অন্যদিকে মেহেরপুরে বিএনপির রয়েছে বিশাল ভোট ব্যাংক। তবে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ভেঙে পড়ে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো। তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা অধিকাংশই মামলা-হামলার ভয়ে নিষ্ক্রিয়।
পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের বেপরোয়া আচরণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে তেমন কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি বিএনপির নেতাকর্মীরা।
মেহেরপুর শহরে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ-সদস্য মাসুদ অরুনের নেতৃত্বে দিবসভিত্তিক ও কেন্দ্র ঘোষিত কয়েকটি কর্মসূচি পালিত হয়েছে। তবে সবই দায়সারা গোছের। জেলা ও প্রান্তিক পর্যায়ের নেতাদের দাবি-পুলিশের নির্যাতনের কারণে তারা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে আছেন। তবে অচিরেই তারা মাঠে নামবেন।
জেলা বিএনপির সভাপতি মাসুদ অরুণ জানান, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। তারা অপেক্ষায় আছেন কেন্দ্রীয় নির্দেশের। কেন্দ্রীয়ভাবে যে নির্দেশ আসবে, তাই তারা পালন করবেন।
এদিকে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আবদুল হামিদ জানান, তিনি এবার জাতীয় নির্বাচনে মেহেরপুর-১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিধ্বস্ত চিরকৌশলী জামায়াতে ইসলামী দলটি দৃশ্যত মাঠেই নেই। দীর্ঘ সময় দলীয় ব্যানারে নেই তাদের কোনো কর্মসূচিও। তবে স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তারা চালিয়ে যাচ্ছে দলীয় কর্মসূচি।
মেহেরপুর-১ (সদর) : এ আসনে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী সংসদ-সদস্য ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রকাশ্য কোন্দল রয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রশ্নে এ কোন্দল আরও বেড়েছে। সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে মাঠে আছেন প্রভাবশালী ডজনখানেক আওয়ামী লীগ নেতা। তাদের অনেকেই এবার নৌকার মনোনয়ন চান। দলটির একাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরহাদ হোসেন।
তার সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক রয়েছেন। দ্বিতীয় পক্ষে নেতৃত্বে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়াজান আলী। আর তৃতীয় পক্ষের নেতৃত্বে আছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রসুল। কোন্দলের কারণে এ আসনে নৌকার বিজয় নিয়ে অনেকটা বিপাকে রয়েছে আওয়ামী লীগ।
নৌকার সম্ভাব্য প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিয়াজান আলী বলেন, দীর্ঘ ১৩ বছর পর দলীয় কাউন্সিল হলেও মিছিল-মিটিং বন্ধ রয়েছে। সবকিছু হয় মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ-সদস্যের ইচ্ছামতো, পদ বণ্টন হয় সংসদ-সদস্যের স্বজনদের মধ্যে। সময়মতো এর জবাব দেওয়া হবে।
নৌকার সম্ভাব্য আরেক প্রার্থী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রসুল বলেন, তার সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, বাস্তুহারা লীগসহ দলের একাধিক অঙ্গসংগঠন রয়েছে। সংসদ-সদস্য ফরহাদ হোসেন নেতাকর্মীদের ডাকেন না। নেতারাও তার কাছে যান না। ‘পরিবারতন্ত্রের’ জেলা কমিটিতে আমাকে জায়গা দেওয়া হয়নি। আগামী সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোট করবেন বলেও মতপ্রকাশ করেন গোলাম রসুল।
পৌর মেয়র ও জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান রিটন বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে অথচ দুর্ভাগ্য যে পৌরসভার উন্নয়নে ক্ষমতাসীন দলের একটি পক্ষ থেকে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ২০১৭ সালের পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছি, অথচ দলের ক্ষমতাধরের কালো ছায়া পৌরসভার উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কোনো সরকারি ও সামাজিক অনুষ্ঠানে পৌর মেয়র হিসাবে আমাকে আমন্ত্রিত করা হলে সেই অনুষ্ঠানে হাজির হন না সংসদ-সদস্য। তিনি যেসব অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন, সেসব অনুষ্ঠানের ব্যানার থেকে আমার নাম বাদ দিয়ে নতুন করে ব্যানার করতে হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সামাজিক সংগঠন অনুষ্ঠান করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে।
মনোনয়নপ্রত্যাশী মেহেরপুরের সাবেক সংসদ-সদস্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বর্তমান সংসদ-সদস্যের কর্মকাণ্ড আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব পড়বে। নৌকার সম্ভাব্য প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ-সদস্য জয়নাল আবেদিন বলেন, মেহেরপুরে দলীয় কোন্দল জন্ম থেকেই। এ দ্বন্দ্ব নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ও ক্ষমতা ধরে রাখার।
নৌকার সম্ভাব্য প্রার্থী মুজিবনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জিয়া উদ্দিন আহমেদ বিশ্বাস বলেন, নৌকার মাঝি পছন্দ না হলে আমি সেই নৌকায় উঠব না। এবার ফরহাদ হোসেন দলীয় মনোনয়ন পেলেও বৈতরণি পার হতে পারবেন না। কারণ, তিনি দলের প্রবীণ কাউকে মূল্যায়ন করেননি। যে জেলা কমিটি হয়েছে, সেই কমিটিও ‘পরিবারতন্ত্র’ কমিটি।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক সংসদ-সদস্য জয়নাল আবেদিন বলেন, যে কোনো মূল্যে এ আসনটি ধরে রাখতে হবে। এ নির্বাচন গতবারের মতো নয়। তিনি আশা করেন, কেন্দ্রীয় নেতারা অবশ্যই সুবিচার করে যোগ্য প্রার্থী মনোনীত করবেন। সংসদ-সদস্য ফরহাদ হোসেন বলেন, আমি স্বচ্ছ রাজনীতি করি। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, মাদকসেবীদের দলে ও আমার কাছে জায়গা নেই। যারা বিরোধিতা করছেন, তারা প্রত্যেকেই বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহায়তা নিয়েছেন।
এদিকে মেহেরপুর-১ আসনে জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক সংসদ-সদস্য মাসুদ অরুন ছাড়া আর কোনো প্রার্থী নেই। বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশনা এলে ভোটের মাঠে নামবেন তিনি।
মেহেরপুর-২ (গাংনী) : এ আসনেও কোন্দলে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ। বর্তমান সংসদ-সদস্য সাহিদুজ্জামান খোকন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান মুকুল, উপজেলা চেয়ারম্যান এমএ খালেক ও সাবেক সংসদ-সদস্য মকবুল হোসেনের গ্রুপে বিভক্ত নেতাকর্মীরা। সরকারের নানামুখী উন্নয়ন তুলে ধরে আওয়ামী লীগ থেকে ছয়জন মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে রয়েছেন।
তারা হলেন বর্তমান সংসদ-সদস্য সাহিদুজ্জামান খোকন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ খালেক, গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক মখলেসুর রহমান মুকুল, সাবেক সংসদ-সদস্য মকবুল হোসেন, সাবেক মেয়র আশরাফুল ইসলাম ও ডা. নাজমুল হক সাগর। তবে দলীয় মনোনয়ন যাকেই দেওয়া হোক, সাবেক সংসদ-সদস্য মকবুল হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি ১৯৯৬ ও ২০১৪ সালে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে টেলিভিশন প্রতীকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে নৌকা প্রতীকে ব্যাপক ভোটে পরাজিত হন। তার সমর্থকরা মনে করেন, বিদ্রোহীই মকবুলের পয়মন্ত।
গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ-সদস্য সাহিদুজ্জামান খোকন বলেন, আমরা বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের দিক তুলে ধরছি। নৌকার পক্ষে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের নিজেদের মধ্যে যে দূরত্ব, সেটাও কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। বিএনপি-জামায়াতের অপপ্রচারের বিরদ্ধে আমরা সোচ্চার। তিনি বলেন, দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার হয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগ কাজ করবে। গাংনী উপজেলা চেয়ারম্যান এমএ খালেক বলেন, মেহেরপুর-২ আসনের মানুষ ইতোমধ্যে জেনে গেছে কাকে মনোনয়ন দিলে গাংনীবাসীর উন্নয়ন হবে। আমরা নিজের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করি না, জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করি। তাদের সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে থেকেছি। আমার বিশ্বাস, শেখ হাসিনা এবার আমাকেই নৌকার টিকিট দেবেন।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী পৌর মেয়র আহামেদ আলী বলেন, বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত নেতাদের নিয়ে রাজনীতি করে। দলের পুরোনো নেতাদের তিনি মূল্যায়ন করেন না। এমন অবস্থায় গাংনী আসনটি আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এমন একজনকে মনোনয়ন দিতে হবে যেন সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা থাকে।
এদিকে কেন্দ্র থেকে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হলে ধানের শীষের মনোনয়ন চাইবেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি জাভেদ মাসুদ মিল্টন, সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ-সদস্য আমজাদ হোসেন, মেহেরপুর জেলা বিএনপির সহসভাপতি মো. আবদুল্লাহ ও গাংনী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবলু। জেলা বিএনপির সহসভাপতি জাভেদ মাসুদ মিল্টন বলেন, গাংনী উপজেলা বিএনপিকে সুসংগঠিত করে বিভিন্ন সময় মিটিং-মিছিল, পদযাত্রা ও সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। এবার মেহেরপুর-২ আসনে ধানের শীষে মনোনয়ন চাইব। তবে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি কিছুই করবেন না বলে জানিয়েছেন।
এছাড়া জামায়াত ইসলামীর মেহেরপুর জেলা শাখার সূরা সদস্য নাজমুল হুদা মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এনডিএম থেকে জাবেদুর রহমান জনিকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি।
