Logo
Logo
×

শেষ পাতা

দেশে তৈরি বৈদ্যুতিক ট্রাক আনল ‘বাংলা কারস’

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশে তৈরি বৈদ্যুতিক ট্রাক আনল ‘বাংলা কারস’

জনপ্রিয় গাড়ি নির্মাতা সংস্থা ‘বাংলা কারস’। এবার বাজারে নিয়ে এলো তাদের নিজেদের তৈরি মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাক ও এসইউভি কার। দুই মডেলের ট্রাক দুটির নাম দেওয়া হয়েছে সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ (2WD BG100E) ও ডাবল কেবিন পিকআপ (4WD BG-100P)। উচ্চগতি এবং আল্ট্রা ফাস্ট চার্জিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে ট্রাক দুটিতে। রয়েছে অত্যাধুনিক অপারেটিং সিস্টেম। বাংলা কারের এই ইভি ট্রাক ও এসইউভি কারে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আপনাকে অবাক করতে পারে। গতিতে যে কোনো তেলবাহী ট্রাককেও হার মানাতে সক্ষম বাংলাদেশের তৈরি এই বৈদ্যুতিক ট্রাক। ফুল চার্জে পাড়ি দিতে পারে ৫৫০ কিলোমিটার রাস্তা। ফাস্ট চার্জার দিয়ে মাত্র ২৮ মিনিটে ট্রাক দুটির সম্পূর্ণ চার্জ সম্ভব। আর সাধারণ চার্জার পয়েন্ট দিয়ে পুরো চার্জ হতে লাগবে সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা। যে কোনো জায়গায় ৪৪০ কেভি বিদ্যুৎলাইনে সহজে এই ইভি ট্রাক চার্জ দেওয়া যায়। এজন্য আলাদা চার্জিং পয়েন্ট বানানোর প্রয়োজন নেই। দুটি ট্রাকের ধারণক্ষমতা রাখা হয়েছে ২ টন। বৈদ্যুতিক এই ট্রাক বিক্রির জন্য বাংলা কারের এবারের স্লোগান ‘বাই দ্য কার ফরগেট দ্য হ্যাসেল’।

বাংলা কারের বৈদ্যুতিক ‘এসইউভি’ বিক্রি শুরু হলেও ট্রাক দুটি একদম ব্র্যান্ড নিউ।

তবে ইতোমধ্যে ইভি ট্রাক ক্রয়ের জন্য অর্ডার নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। ট্রাকের অগ্রিম ফরমায়েশ নেওয়ার জন্য ঢাকায় তিনটিসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকটি শোরুম চালু করেছে বাংলা কারস। দেশব্যাপী ফ্রাঞ্চায়েজ খোলারও কাজ চলছে।

বিদেশি দাইয়্যুন অটোমাবাইল মিৎসুবিশি কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে বৈদ্যুতিক গাড়ির অ্যাসেম্বলিং করছে বাংলা কারস। নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি এলাকায় ১৫ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে অত্যাধুনিক এই অ্যাসেম্বলিং কারখানা। মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা এই গাড়ি নির্মাণের জন্য এখানে দেশি বিদেশি ২৫ জনের বেশি প্রকৌশলী কাজ করছেন।

বৈদ্যুতিক এই ট্রাক দুটি খুবই জ্বালানি সাশ্রয়ী। একবার চার্জ হতে বিদ্যুৎ খরচ হয় মাত্র ৫০ কিলোওয়াট। এতে ব্যায় হয় মাত্র ৯৯৬ টাকা। অথচ তেলচালিত একটি ট্রাকের এই পরিমাণ পথ চলতে জ্বালানি খরচ লাগে ৭ হাজার টাকার বেশি অর্থ।

‘বাংলা কারস’ হোসাইন গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। দেশের বাজারে ইভি ট্রাক তৈরি প্রসঙ্গে গ্রুপের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাকির হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, ইভি ট্রাকে জ্বালানি খরচ নেই বললেই চলে। শব্দদূষণও হয় না। মেইনটেন্যান্স খরচও কম। তাছাড়া এই ট্রাকের রিসেলস ভ্যালু খুবই ভালো। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে, জীবাশ্ব জ্বালানির ব্যবহার কমাতে বিশ্বজুড়ে আন্দোলন চলছে। এ ক্ষেত্রে একটি সুখবর হচ্ছে বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) ক্রমবর্ধমান চাহিদা। বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা যত বাড়বে, তেলের ব্যবহারও তত কমবে। কারণ বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের চাহিদার ৬০ শতাংশ তৈরি হয় পরিবহণ খাত থেকে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে বিদ্যুৎ খাতে অসাধারণ উন্নয়ন সাধন করেছেন। দেশব্যাপী প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। আগামীতে সরকারিভাবেও রাস্তার পাশে বৈদ্যুতিক গাড়ির চার্জিং স্টেশন বসানো শুরু হয়েছে।

তেল (জ্বালানি) চালিত একই মডেলের একটি ট্রাকের সঙ্গে বৈদ্যুতিক ট্রাকের জ্বালানি খরচ ক্যালকুলেশন করে তিনি বলেন, বাংলা কারস আপ টু ২ টন পিকআপ ব্যাবহারে প্রতি চার্জে গ্রাহকের খরচ বাঁচবে কমপক্ষে ৬৩০৫ টাকা। কারণ এক চার্জে ইভি ট্রাকের বৈদ্যুতিক খরচ মাত্র ৯৫০ (প্রতি কিলোওয়াট ১৯ টাকা হিসাবে) টাকা। আর তেলবাহী ট্রাকের খরচ হবে ৫৬ লিটার তেল। প্রতি লিটার অকটেনের দাম ১৩০ টাকা হিসাবে এতে খরচ হবে ৭২৮০ টাকা।

হোসাইন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসাইন বলেন, করোনাপরবর্তী ২০২১ সালে নিজেদের তৈরি প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাক নির্মাণে হাত দেয় বাংলা কারস। মাত্র ২ বছরের মাথায় এসেছে সফলতা। পিকআপ মডেলের ট্রাক দুটিতে সুপার ইলেকট্রিক মোটর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে টেসলা বা পোরশের তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ির তুলনায় বেশি গতি পাওয়া যাবে বাংলা কারের গাড়িতে। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাক দুটির কেবিন খুবই সুন্দর বড় ও আকর্ষণীয়। ট্রাকগুলো যখন চলে তখন বাইর থেকে কোনো শব্দ পাওয়া যায় না। ট্রাক এবং এসইউভি কারের পার্টস ও চেসিস যথাক্রমে চায়না ও ইন্দোনেশিয়া থেকে এবং ইঞ্জিন জাপান থেকে আমদানি করা হয়। তাদের কারখানায় বর্তমানে বছরে ৬০০ ইউনিট ট্রাক অ্যাসেম্বল করা সম্ভব। আগামীতে বছরে ১ হাজারের বেশি ইভি ট্রাক তৈরির টার্গেট আছে বলেও জানান মি. হোসাইন। এই কোম্পানির ট্রাক বাংলাদেশে প্রথম বাজারজাত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। তাদের ইভি ট্রাকের ব্যাটারি এবং কন্ট্রোলারে পাঁচ বছরের ওয়ারেন্টি অথবা ১ লাখ কিলোমিটার চলাচলের ওয়ারেন্টি রয়েছে। এছাড়া অন্য সব ধরনের সার্ভিস সুবিধা থাকবে। তাদের মূল সার্ভিস সেন্টারটি রাজধানীর তেজগাঁওতে অবস্থিত। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী যে কোনো কালারের ট্রাক প্রস্তুত করে দিতে পারবে বাংলা কারস। বৈদ্যুতিক এই ট্রাকগুলোর দাম ৩০ থেকে ৭০ লাখ টাকা।

বাংলা কারের তথ্য মতে, কম তাপমাত্রায় চার্জের জন্য বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে বৈদ্যুতিক গাড়িতে। ফলে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে দ্রুত চার্জ করা যাবে। এ ছাড়া এসব ট্রাক ব্যবহারকারীদের সুবিধার্থে সারা দেশে কেন্দ্রীয়ভাবে চার্জিং স্টেশন বসানোর পরিকল্পনা আছে।

মি হোসাইন বলেন, দেশে দেশে বৈদ্যুতিক গাড়িতে রূপান্তরে নীতি সহায়তা গেম চেঞ্জার হিসাবে ভূমিকা রাখছে। এতে যানবাহনে জ্বালানি তেলের চাহিদা কমছে, এতদিন যেটি তেলের চাহিদা বৃদ্ধিতে মূল ভূমিকা রেখে আসছিল। বিভিন্ন দেশে সরকার ইতোমধ্যে বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরিতে ভর্তুকি দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারকেও এই সেক্টরের উন্নয়নে ভর্তুকি প্রদানের দাবি জানান তিনি। তার মতে এখানে ভর্তুকি অব্যাহত থাকলে বৈদ্যুতিক ব্যাটারির দাম কমে আসবে, এতে পরিবেশবান্ধব এই গাড়ির ব্যবহারও বেড়ে যাবে।

জানা গেছে, বিশ্বে তেলের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ হয় পরিবহণ খাতে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই ১০ শতাংশ তেলের চাহিদা তৈরি করে। বৈদ্যুতিক গাড়ি বৃদ্ধির ফলে এই চাহিদা আস্তে আস্তে কমে আসছে। বৈদ্যুতিক গাড়ি ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে জ্বালানি তেলের চাহিদা দৈনিক ৫০ লাখ ব্যারেল কমাবে। ২০২২ সালে সারা বিশ্বে এক কোটির বেশি বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে। ২০২১ সালের তুলনায় এই সংখ্যা প্রায় ৫৫ শতাংশ বেশি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যে হারে ইভির চাহিদা বাড়ছে, তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে মোট বিক্রি হওয়া গাড়ির ৩৫ শতাংশই হবে বৈদ্যুতিক ধরনের। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) তথ্যমতে ২০২২ সালে বিশ্বের সড়কগুলোতে দুই কোটি ৬০ লাখের (২৬ মিলিয়ন) বেশি ইভি চলাচল করেছে। এই পরিমাণ ২০২১ সালের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি।

সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ২৩ লাখের বেশি বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে। এই সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। এভাবে চলতে থাকলে চলতি বছর শেষে বিশ্বব্যাপী ইভি বিক্রির সংখ্যা এক কোটি ৪০ লাখ ছাড়াতে পারে। প্রত্যাশিত সংখ্যায় ইভির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে চলতি দশক শেষে দৈনিক ৫০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমবে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম