খেলার মাঠে বরিশালের ফেসবুক-টিকটক প্রজন্ম
আবার ফিরেছে লুডু, দল বেঁধে টিভি দেখা
আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল
প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইন্টারনেট নেই, নেই ফেসবুক-টিকটক-ইনস্টাগ্রাম। এমন বাস্তবতায় সময় কাটাতে আবার খেলার মাঠে ফিরেছে কিশোর-তরুণরা। কদিন ধরে দারুণ জমজমাট বরিশালের খেলার মাঠগুলোসহ ফাঁকা সড়ক আর বাড়ির আশপাশের খোলা জায়গা। চলছে ফুটবল-ক্রিকেটসহ নানা খেলা। কিশোরী-তরুণীদের আচরণেও এসেছে পরিবর্তন। যারা লেগে থাকত মোবাইল ফোনে, তারাই এখন সময় কাটাতে হাতে নিয়েছে লুডু-দাবা। বউছি আর গোল্লাছুটের মতো প্রায়বিলুপ্ত খেলাগুলোও ফিরে এসেছে ইন্টারনেট না থাকায়। বিষয়টিকে বর্তমান প্রজন্মের জন্য ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন অভিভাবকরা। তাদের মতে, মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে ঝিমানো নয়, খেলার মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো প্রজন্মই সবার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন এক যুগেরও বেশি সময় হারিয়ে ফেলেছি আমরা।
কোটা আন্দোলন পরিস্থিতি সামাল দিতে বুধবার রাত থেকে কমিয়ে দেওয়া হয় মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটের গতি। এরপরও অবশ্য চালু ছিল ওয়াইফাই-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ। পরে মহাখালী ডেটা সেন্টারে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট। টানা সাতদিন চলছে এ অবস্থা। ইন্টারনেট না থাকায় অন্য সব কার্যক্রমের পাশাপাশি বন্ধ রয়েছে ফেসবুক-টিকটক-ইনস্টগ্রাম-এক্সসহ বর্তমান প্রজন্মের অত্যন্ত জনপ্রিয় বেশকিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কেবল কথা বলা ছাড়া মোবাইল ফোনে এখন আর কিছু করতে পারছে না কেউ। সত্তরের দশক কিংবা এর আগে জন্মের মানুষ খুব সহজেই এ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলেও বিপাকে পড়েছে নব্বই-পরবর্তী প্রজন্ম। যেন আটকা পড়েছে বন্দি খাঁচায়। প্রথম দুদিন অনেকটা ছটফট করে কাটে তাদের সময়। ফেসবুক-টিকটক না থাকায় সময় কাটানোর মতো কিছুই পাচ্ছিল না তারা। পরে অবশ্য বদলাতে শুরু করে পরিস্থিতি। যে কোনো উপায়ে সময় কাটাতে তাদের হাতে ওঠে ফুটবল-ক্রিকেট। আবারও খেলার মাঠে পা পড়ে তরুণ-কিশোরদের।
গত কদিন বরিশালের খেলার মাঠগুলো ঘুরে চোখে পড়েছে এসব কিশোর-তরুণের সরব উপস্থিতি। বৃষ্টি-কাদায় মাখামাখি হয়ে দারুণ দুরন্তপনা। মঙ্গলবার সকালে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ মাঠে বেশ কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে চলছিল ফুটবল খেলা। কম করে হলেও একশর বেশি তরুণ-কিশোর খেলছিল মাঠে। চারপাশে ভিড় করে খেলা দেখছে আরও অন্তত শ দুয়েক। কলেজের পেছনের বাসিন্দা গফুর মিয়া বলেন, ‘প্রায়ই সকাল-বিকাল হাঁটতে আসি এ মাঠে। আজ না হেঁটে বসে বসে বাচ্চাদের খেলা দেখছি। ছোটবেলায় আমরাও খেলতাম এভাবে। তখন মোবাইল ফোন ছিল না, ছিল না ফেসবুক-টিকটক। এ মোবাইল এসে বাচ্চাদের সবকিছু পালটে দিয়েছে। খেলা দেখছি আর ভাবছি আমাদের ছেলেবেলার কথা।’ মাঠের পাশের সড়কের পথচারী ব্যাপ্টিষ্ট মিশন রোডের বাসিন্দা মুনসুর আলী বলেন, ‘বাচ্চারা এভাবে খেলার মাঠে থাকলে আর কোনো টেনশন থাকত না আমাদের। আমার ছেলেটা নেশা করছে কি না, আমার মেয়েটা কোনো ভুল করছে কি না, সেসব ভাবনা অনেকটাই কমে যেত।’
কেবল মেডিকেল কলেজ মাঠ নয়, সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের মাঠ, পরেশ সাগরের মাঠ, জিলা স্কুল মাঠ, আউটার স্টেডিয়াম মাঠসহ নগরীর প্রায় সব খেলার মাঠেই কদিন ধরে চোখে পড়েছে বিপুলসংখ্যক কিশোর-তরুণের খেলার দৃশ্য। পরেশ সাগর মাঠে ফুটবল খেলতে থাকা কিশোর মিজান জানায়, পাশেই ব্রাউন কম্পাউন্ড সড়কে বাসা তার। যারা খেলছে, তাদের প্রায় সবারই বাসা মাঠের আশপাশের এলাকায়। কারফিউ চললেও সেখানে খুব একটা যান না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এক প্রশ্নের উত্তরে মিজান বলে, ‘আগে কখনো এভাবে খেলতে আসিনি। এখন তো মোবাইল ফোনে নেট নেই। তাই ফেসবুক-টিকটকও চলে না। সময় কাটেনা, তাই মাঠে এসেছি।’ প্রায় একই উত্তর মেডিকেল কলেজ মাঠে খেলতে আসা শাওন, জিলা স্কুল মাঠের আবীর এবং হাতেম আলী কলেজ মাঠে থাকা কিশোরের। এর আগে তারা কখনোই খেলেনি মাঠে। একটানা ৬-৭ দিন নেট বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে মাঠে নামা। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাঠগুলোয় যে বাচ্চারা খেলাধুলা করছে, তা জানি আমরা। জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিইনি। তারা তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য ভীতিকর নয়। উলটো আমরা চাই, বাকি যারা ঘরে আছে, তারাও এভাবে খেলতে আসুক। জীবনধারণের পদ্ধতি বদলে যাক এই প্রজন্মের।’
কিশোর-তরুণরাই কেবল নয়, ইন্টারনেট না থাকায় কিশোরী-তরুণীদের অভ্যাসেও এসেছে পরিবর্তন। নগরের আমানতগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা গৃহবধূ তাসনিম রহমান বলেন, ‘আমার ৩ মেয়ে প্রায় সারা দিনই মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকত। কারফিউ শিথিলের সময়ে তাদের জন্য লুডু-দাবা কিনে এনেছি। এখন তারা দাবা আর লুডু খেলে সময় কাটায়। আগে যেখানে ডেকে গলা ফাটিয়েও কাছে পেতাম না, সেখানে এখন নিজেরাই এসে আমার সঙ্গে গল্প করে, ঘরের টুকটাক কাজে হাত লাগায়।’ নবগ্রাম সড়কের বাসিন্দা চাকরিজীবী ওমর ফারুক বলেন, ‘কলেজে ওঠার পর থেকেই ছেলে-মেয়েগুলো কেমন যেন আলাদা হয়ে গিয়েছিল। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার পর তারাই এখন যেচে এসে পাশে বসে, গল্প করে, দুষ্টামি করে। এটা যে কত আনন্দের বোঝাতে পারব না।’ বটতলা এলাকার বাসিন্দা মুন জাহান বলেন, ‘ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এখন একসঙ্গে বসে টিভিতে নাটক দেখি, সিনেমা দেখি। আগে তো একেকজন একেক দিকে মুখ ফিরিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে বসে থাকত। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সেই পুরোনো আন্তরিকতাটা যেন আবার ফিরে এসেছে।’ কারফিউর ভয়ে প্রধান সড়কে না গেলেও ঘরের আঙিনায় গোল্লাছুট-দাড়িয়া বান্ধা আর বউছির মতো প্রায়বিলুপ্ত খেলা খেলতে দেখা গেছে বহু কিশোর-কিশোরীকে। অনেক বাসা থেকে মিলেছে ক্যারম খেলে সময় কাটানোর খবর।
বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল আসক্তির কারণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের সন্তানরা। মোবাইল ফোন থেকে শিক্ষণীয় কিছু যে নেই তা নয়; কিন্তু স্বভাবজাতভাবে মানুষ নেতিবাচকটাই আগে গ্রহণ করে। আমাদের সময় ছিল পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল আর ক্রিকেটের প্রতিযোগিতা। ক্লাব-পাঠাগারে বই পড়া আর খেলাধুলা করে সময় কাটত তরুণদের। চলত নাটক-কবিতা আবৃত্তি আর নাচগানের প্রতিযোগিতা। সেসবই তো এখন অতীত। বাচ্চাদের যদি আমরা আবার মাঠে ফেরাতে পারতাম, তাহলে এই যে নেশা আসক্ত প্রজন্ম, টিকটক-ফেসবুক আসক্তি, এসবের কিছুই আর থাকত না। আবার শুরু হতো সত্যিকারের মেধার লড়াই।’ বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্যসচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল ফোনের বিরুদ্ধে নই; কিন্তু যেসব অ্যাপ বাচ্চাদের ক্ষতি করছে, মেধা বিকাশের পথ রুদ্ধ করে পঙ্গু বানাচ্ছে, সেসব অ্যাপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখনই সময়। আমরা নাচুনে-নাচনেওয়ালী কিংবা ভাইরাল হওয়ার নেশায় আদর্শহীন কর্মকাণ্ডে বুঁদ হয়ে থাকা তরুণ-তরুণী চাই না, আমরা চাই শিক্ষা-মেধা-মননে বিশ্ব জয় করা প্রজন্ম।’
