আবার মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ফের বন্ধ করা হয়েছে মোবাইল ইন্টারনেটের ফোর-জি নেটওয়ার্ক। রোববার বেলা ১২টার পর থেকেই এই সেবা বন্ধ করা হয়। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সচল থাকলেও গতি খুবই স্লো। গ্রাহকরা ফেসবুক ও মেসেঞ্জার অ্যাপে ঢুকতে পারছে না। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামও। এতে বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
মোবাইল ফোন অপারেটররা জানান, দুপুর পৌনে ১টার দিকে সরকারি নির্দেশে তারা ফোর-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ রেখেছেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এটি বন্ধ থাকবে। তবে ২জি নেটওয়ার্ক চালু থাকায় কথা বলা যাচ্ছে। যদিও সাধারণ মানুষের অভিযোগ ২জি নেওয়ার্ক দিয়েও ভালোভাবে কথা বলা যাচ্ছে না। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫৪ লাখেরও বেশি। যার মধ্যে সাড়ে ১১ কোটির বেশি ব্যবহারকারী মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একটি মোবাইল অপারেটরের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসার বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকারি নির্দেশের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু থাকলেও কাক্সিক্ষত গতি পাচ্ছেন না বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। কোনো কোনো এলাকায় ব্রডব্যান্ডের গতি খুবই কম।
এদিকে দেশব্যাপী ফোরজি ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলেও কোনো নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি বলেন, আমরা কোথাও ইন্টারনেট বন্ধ করিনি। বন্ধের কোনো নির্দেশও দেইনি। কোথাও কোথাও ইন্টারনেটের সমস্যা হচ্ছে। তিনি জানান, ফাইবার অপটিক্যাল কেবল ও ইন্টারনেট পরিচালনায় অনেক স্থাপনায় সন্ত্রাসীরা হামলা চালাচ্ছে। অনেক জায়গায় হামলা চলছে। ফাইবার কেবল কেটে দেওয়া হচ্ছে। আজও আমাদের কয়েক জায়গায় আগুন দেওয়া হয়েছে। অনেক এলাকায় কেটে ফেলা হয়েছে। এমন তাণ্ডব চালালে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সরবরাহ করা তো সম্ভব নয়।
সূত্র জানায়, রোববার দুপুর ১টার পর থেকে মেটার প্ল্যাটফর্ম-ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম বন্ধের নির্দেশ দেয়। এরপর থেকেই এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রাহকরা প্রবেশ করতে পারছে না। তবে ইউটিউব এখন সচল রয়েছে। এদিকে সরকার পদত্যাগের একদফা দাবিতে রোববার থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ফের মোবাইল ইন্টারনেটসহ বন্ধ হয়েছে। সঙ্গে বন্ধ রয়েছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রামও।
যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা নুসরাত জাহান যুগান্তরকে বলেন, দুপুর ১টার পর আর কোনো নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিতে গিয়ে দেখি কল যাচ্ছে না। এমনকি মেসেজও দেওয়া যাচ্ছে না। বারবার মোবাইল ডেটা বন্ধ করে চালু করেছি, ফোন রিস্টার্ট দিয়েছি, কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। পরে বুঝতে পারলাম মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ। এভাবে বার০বার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অনেক জরুরি প্রয়োজনে দেশের বাইরে যোগাযোগ করতে পারছি না।
ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র জানায়, মোবাইল ইন্টারনেট বা ফেসবুক বন্ধের বিষয়ে কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। অন্যদিকে মোবাইল অপারেটররা জানায়, কর্তৃপক্ষ মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রেখেছে। পরবর্তী নির্দেশনার জন্য তারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক যুগান্তরকে বলেন, আমাদের কাছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করার জন্য এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। আর তাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু থাকবে। তবে সোশ্যাল মিডিয়াগুলো বন্ধ থাকতে পারে। আমাদের দিক থেকে বলতে পারি, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হবে না। তিনি বলেন, বন্ধের জন্য আমাদের পর্যন্ত নির্দেশনা আসতে হয় না। আমাদের ওপরে আরও দুটি ধাপ রয়েছে। বন্ধ করার হলে তারাই বন্ধ করে দেয়। আমরা তো শুধু প্রোভাইডার।
প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ-সংঘাতের জেরে গত ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৮ জুলাই রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাঁচ দিন পর গত ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত পরিসরে ফেরে। আর ১০ দিন পর গত ২৮ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়। কিন্তু বন্ধ ছিল মেটার প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম। এছাড়া তখন টিকটকও বন্ধ রাখা হয়। অন্যদিকে ব্রডব্যান্ড সংযোগে ইউটিউব চালু থাকলেও মোবাইল ডেটায় তা বন্ধ ছিল। পরে গত ৩১ জুলাই বেলা ২টার পর থেকে বাংলাদেশে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো চালু করা হয়। তবে গত শুক্রবার দুপুর সোয়া ১২টার পর মোবাইল নেটওয়ার্কে মেটার প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্যাশ বন্ধ করা হয়।
পাশাপাশি এই নেটওয়ার্কে টেলিগ্রামও বন্ধ করা হয়। সেদিন সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার পর তা আবার চালু করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক আসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এভাবে বারবার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ইন্টারনেট সেবা এখন জনগণের মৌলক অধিকার। সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। আমি আগেও বলেছি, কথায় কথায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া কখনো সমাধান হতে পারে না।
এর আগে ইন্টারনেট, ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের কারণে দুই সপ্তাহে তথ্যপযুক্তি, সফটওয়্যার, এফ-কমার্স, ই-কমার্স খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। যারা এই ক্ষতির শিকার হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই তরুণ এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। অনেকেরই আয়ের একমাত্র অবলম্বন ফেসবুক ও ইউটিউব।
এর পাশাপাশি ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে দেশের অন্যান্য খাতে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো বহু বিদেশি ক্রেতার আস্থা নষ্ট হয়েছে। অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি এই ক্ষতি কতটা কাটিয়ে ওঠা যাবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশেন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সফটওয়্যার সার্ভিসেস (বেসিস)-এর সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, ‘সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ‘লাইফ লাইন’ হলো ইন্টারনেট। দীর্ঘসময় ধরে ইন্টারনেট ও ফেসবুক বন্ধের কারণে সদূরপ্রসারী বিপুল ক্ষতি হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে আর্থিক ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে। কয়েকদিন পর এটা বলা যাবে। আনুমানিক কয়েক হাজার কোটি টাকা হবে। কিন্তু বিশ্ববাজারে আইটি খাতে অন্তত হাজার কোটি টাকার ওপর ক্ষতি হয়েছে। অনেক ক্রেতা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এভাবে ২৫ শতাংশ ক্রেতাও যদি চলে যায় তাহলে তার ধাক্কা সামলাতে লাগবে অন্তত এক বছর।’
