মৃত বাবার দেহে ছররা-গুলি
মা-বাবাকে হারিয়ে এতিম ছোট্ট শিশু
ঢামেক হাসপাতাল মর্গে স্বজনদের আর্তনাদ * থানা বন্ধ, নেই পুলিশ-ময়নাতদন্তে বিলম্ব
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ছোট্ট তাসফিয়ার কেউ রইল না। ৩ বছরের শিশুটি বুঝতে পারছে না সে কি হারিয়েছে। বছরখানেক আগে মা, সম্প্রতি বুলেট কেড়ে নিয়েছে বাবাকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ৫ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টায় বের হয়েছিলেন ছোট্ট তাসফিয়ার বাবা বাপ্পী আহমেদ। রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বরের বাসায় মোবাইল রেখে বাপ্পী নিচে নেমেছিলেন চা খেতে। মাত্র কয়েক মিনিট, এরপর থেকেই নিখোঁজ বাপ্পী। ওই দিন সারা রাত তার সন্ধান চলে, কিন্ত কোথাও খোঁজ মেলেনি। পরদিন ৬ আগস্ট বাপ্পীর নিথর দেহ মেলে হাতিরঝিলে। দুপুরে উদ্ধারের পর দেখা যায় তার দেহে অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন। বাপ্পীর লাশ ৬ আগস্ট থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে স্তূপীকৃত লাশের সঙ্গে পড়ে আছে। ময়নাতদন্তের জন্য অপেক্ষা, কিন্তু থানার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। মর্গের সামনে আর্তনাদ করছিলেন বাপ্পীর মা-বাবা, স্বজনরা।
মেধাবী বাপ্পী যুক্তরাজ্যে ৪ বছর পড়াশোনা করেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির। বাবা শাহিদ উদ্দিন, মা সুরাইয়া বেগমের বিলাপ চলছেই। মর্গের সামনে বুক থাপড়ে বলছিলেন, ‘কি দোষ ছিল আমার ছেলের, তাকে কেন গুলি করে হত্যা করা হলো। তাকে ছাড়া আমরা কেমনে বাঁচব।’ এমন আর্তনাদে তারা বারবার চেতনা হারাচ্ছিলেন। আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনরাও নিজেদের কান্না ধরে রাখতে পারেননি। মর্গের চারপাশে লাশের গন্ধ। কিন্তু স্বজনদের কান্নায় ম্লান হচ্ছিল সেই গন্ধ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাপ্পীর লাশ আনা হয় ঢামেক হাসপাতাল জরুরি বিভাগে। ওই সময়ও গলিত-অর্ধগলিত লাশ, গুরুতর আহত মানুষ আসছিলেন হাসপাতালে। জরুরি বিভাগের ভেতর, বাইরে আহত মানুষের আর্তনাদ। মর্গে লাশের স্তূপ। বাপ্পীর স্বজনরা বলছিলেন, প্রিয় মানুষটির লাশ যেন ময়নাতদন্ত করা হয় দ্রুত। ৭ নম্বর রুমের বাইরে রাখা হয় বাপ্পীর নিথর দেহ। অপরদিকে ‘জরুরি মর্গে’ লাশের ওপর লাশ। বাপ্পীর খালাতো বোন খালেদা আক্তার পুনম বলছিলেন, ‘বাপ্পীর লাশ ময়নাতদন্ত করে খুনিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। মানুষ আনন্দ করছে, যেন নতুন করে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু বাপ্পীর মতো শত শত মানুষকে খুন করা হয়েছে গুলি করে। এর বিচার নিশ্চিত করা না হলে নতুন স্বাধীনের কোনো মূল্য থাকবে না।’
পুনম বললেন, বাপ্পী খুব মেধাবী। বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে দেশে এসেছেন, মাতৃভূমিকে কিছু দিতে। মাতৃভূমিতেই তার প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো। তার কোলে ঘুমাত ৩ বছরের ছোট্ট শিশু তাসফিয়া। মা ইতি ইসলাম মারা গেছেন বছরখানেক আগে। ছোট্ট শিশুটি জানে না মা-বাবা হারানোর বেদনা কেমন। মায়ের পরে বাবাই ছিল তার একমাত্র ভরসারস্থল। কিন্তু সেও চলে যাওয়ায় তাসফিয়া এখন এতিম।
বুধবার ভোর থেকেই বাপ্পীর স্বজনরা মর্গের পাশে অপেক্ষা করছিলেন। বাবা শাহিদ আহমেদ জানান, তার ছেলে বাপ্পীর মতো বহু লাশ মর্গে পড়ে আছে। গুলিবিদ্ধরা হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। ছেলে হত্যার বিচার কে করবে-ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চান। বাপ্পীর শরীরে অসংখ্য ছররা, বুলেটের চিহ্ন। মা সুরাইয়া বেগম শুধু বুক থাপড়াচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘আমার বাবাকে এনে দাও, আমার বাবা ছাড়া আমি কেমনে থাকব। আমার বাবাকে কেন গুলি করে হত্যা করা হলো।’
হাসপাতাল মর্গে লাশের স্তূপ : ৫ আগস্ট রাত থেকেই হাসপাতাল মর্গে লাশের স্তূপ জমতে থাকে। লাশ ময়নাতদন্তে পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট থানার ক্লিয়ারেন্স লাগে। এ ক্ষেত্রে রাজধানীর প্রায় সব থানার কার্যক্রম বন্ধ। নেই পুলিশ, কে দেবে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। এক মর্গ সহকারী জানান, জরুরি বিভাগের পাশে একটি মর্গ রয়েছে, সেখানে লাশে পচন ধরেছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকেই অর্ধগলিত পুলিশের লাশ নিয়ে আসা হচ্ছে। হাসপাতালে মৃতদেহের রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, কোল্ড স্টোরেজ চেম্বার সবই লাশে ভর্তি। মঙ্গলবার মধ্যরাতে জরুরি বিভাগ মর্গে গিয়ে দেখা যায় অন্তত ১৮-২০টি লাশ পড়ে আছে। ছোট্ট রুমটিতে পড়ে থাকা লাশগুলোর অধিকাংশই অর্ধগলিত। মর্গে দায়িত্বে থাকা এক শ্রমিক জানান, আশপাশ গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। কারও মাথার মগজ বের হওয়া, কারও নাড়িভুঁড়ি। কারও শরীরে অসংখ্য গুলির চিহ্ন। এসব লাশ দ্রুত পচন ধরে। অনেক স্বজনরা ভিড় জমাচ্ছেন। অনেকে ময়নাতদন্ত না করেই লাশ নিয়ে যাচ্ছেন।
ঢামেক হাসপাতালের নিচ তলার ৭ নম্বর রুমে লাশের হিসাব লেখা হয়। মৃত ব্যক্তির নাম-ঠিকানা, অজ্ঞাত হলে কে নিয়ে এসেছেন, কোথা থেকে আনা হয়েছে ইত্যাদি। রুমটির দায়িত্বে থাকা এক কর্মচারী জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনে যে সব লাশ এখানে লিপিবন্ধ করা হচ্ছে সেগুলো প্রথমে জরুরি মর্গে এবং পরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। কিন্তু দুটি মর্গেই লাশের স্তূপ জমেছে। থানাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ থাকায় যথাযথ উপায়ে ময়নাতদন্তও করা যাচ্ছে না। বুধবার বিকালে কথা হয় মর্গে থাকা এক মর্গ সহকারীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, মঙ্গলবার রাতে ও বুধবার সকালে আসা ৮-১০টি পুলিশের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এসব লাশের বেশিরভাগই রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল থেকে এসেছে। হাসপাতালের ফ্রিজগুলো লাশে ভরা। সবই পুলিশ কেস, কিন্তু পুলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। ময়নাতদন্ত বিলম্বিত হওয়ায় অনেকের স্বজন ময়নাদন্ত ছাড়াই মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে কাউকে হাসপাতাল থেকে মৃত্যুসনদ বা ডকুমেন্ট দেওয়া হচ্ছে না। স্বেচ্ছায় মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছেন এমন কাগজে স্বজনদের স্বাক্ষর রাখা হচ্ছে মাত্র।
