Logo
Logo
×

শেষ পাতা

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে বেপরোয়া চাঁদাবাজি

Icon

এম এ কাউসার, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে বেপরোয়া চাঁদাবাজি

চট্টগ্রামে প্রায় সব সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের আঞ্চলিক করপোরেট অফিস রয়েছে নগরীর আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায়। রয়েছে বড় বড় কোম্পানির করপোরেট অফিস, শিপিং অফিস, বন্দর-কাস্টমকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান কার্যালয়ও। ফুটপাতের বড় বাণিজ্যও রয়েছে নগরীর ব্যস্ততম এলাকা হিসাবে পরিচিত এ বাণিজ্যিক এলাকায়। বিশাল এ ব্যবসা-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে এখানে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজচক্র। আওয়ামী লীগের আমলে সন্ত্রাসীরা দলীয় গডফাদারদের আশ্রয়ে চাঁদাবাজি করলেও এখন সেই চাঁদাবাজি হাতবদল হয়ে এসেছে বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের চাঁদাবাজদের হাতে। ফুটপাত থেকে শুরু করে শিপিং অফিস-সবখানেই এখন তাদের থাবা। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা ভয়ে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখও খুলতে পারছেন না।

ইতোমধ্যে চাঁদাবাজিতে বাধা দেওয়ায় প্রতিপক্ষের হামলায় চট্টগ্রাম মহানগর তাঁতীদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নুরুল আলম নিহত হয়েছেন। দুই সপ্তাহ পার হলেও কাউকে এখনো পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। নগরীর ডবলমুরিং থানাধীন আগ্রাবাদ জাম্বুরী মাঠ এবং আশপাশের এলাকায় বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে একাধিক গ্রুপ বিভিন্ন গুদাম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি শুরু করে। এতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন নুরুল আলম। দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় তিনি প্রতিবাদ করলেও শেষ পর্যন্ত তাকেই খুন হতে হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল এলাকা এবং এর আশপাশে ফুটপাত ও সরকারি জায়গায় ব্যবসা-বাণিজ্যের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো অফিস খুলে বসেছে বিএনপির চিহ্নিত কিছু চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর থেকে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু এর প্রতিবাদ করেন নুরুল আলম। পরে ২৭ অক্টোবর হামলার শিকার হয়ে ২ নভেম্বর তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

আগ্রাবাদের ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও সাধারণ বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিপিং অফিস, ফুটপাত ও বাস্তুহারা কলোনিসংলগ্ন মাঠে বিভিন্ন ঠিকাদারের মালপত্র রাখার বিপরীতে চাঁদাবাজিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আখতার হোসেন বাবলু। সদরঘাট থানা এলাকার বাসিন্দা এই বাবলু রীতিমতো এক আতঙ্কের নাম। লিডমন্ড শিপিং, রেনু শিপিংসহ বিভিন্ন শিপিং অফিসে ভেন্ডরিং কাজের জন্য মালিক কর্তৃপক্ষকে বাবলু বাধ্য করেন। জাহিদুল ইসলাম ও নুরুদ্দীন সোহেল নামে ডবলমুরিং থানা বিএনপির দুই নেতার নামে ফুটপাতের প্রতিটি দোকান থেকে চাঁদা তোলা হয়। এ দুই বিএনপি নেতাকে চাঁদা না দিলে বসতে পারছে না ফুটপাতের দোকান। বিকালের পর আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার ফুটপাতে বিশাল জুতার বাজার বসে। এই জুতার বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন জাহিদ ও সোহেল! শিপিং অফিসের ভেন্ডরিং কাজের জন্য হানা দেন তারা। আগ্রাবাদ এলাকায় শখানেক শিপিং অফিস রয়েছে। সূত্র জানায়, প্রতিমাসে কয়েক কোটি টাকার ভেন্ডরিং কাজ হয়। মূলত এ কাজের নিয়ন্ত্রণ নিতেই গ্রুপগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে। বেলায়েত হোসেন নামে এক শিপিং ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, তাদের জাহাজ বন্দরে ভিড়লেই একেক সময় একেক গ্রুপ এসে কাজ দাবি করে। না দিলে হুমকি-ধমকি দেয় বা চাঁদা দাবি করে। এ কারণে তার মতো অনেক শিপিং ব্যবসায়ী অতিষ্ঠ। কিন্তু এ অভিযোগ নিয়ে কার কাছে যাবেন?

আগ্রাবাদ ডেবার ইজারা ও বড়শি প্রতিযোগিতার জন্য চাঁদা দিতে হয় ইয়াসিন রাজুকে। তিনি মহানগর কৃষক দলের নেতা হিসাবে এলাকায় পরিচিত। এছাড়া ডেবারপাড়ের বাসিন্দা স্বেচ্ছাসেবক দলের সজল বড়ুয়া, দাম্মাপুকুরপাড়ের ফজলুর রহমান মুন্না, সালেহ আহমদ চেয়ারম্যান লেনের বাসিন্দা খলিলুর রহমান বাপ্পি, নজির ভান্ডার লেনের বিএনপি নেতা জসিম, ডেবারপাড়ের বিএনপি নেতা আকবরের বিরুদ্ধেও ফুটপাতসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক অফিসে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তাঁতীদল নেতা নুরুল আলম হত্যা মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের সামনে নুরুল আলমের একটি ভাতের দোকান রয়েছে। ঘটনার দিন সকালে তিনি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যান। বিকাল ৪টার দিকে মো. আলমগীর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ডাম্পিং থেকে কিছু লোহার মালামাল চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় বাধা দেন নুরুল আলম। এতে আলমগীর ক্ষিপ্ত হয়ে নুরুল আলমের সঙ্গে তর্ক করে একপর্যায়ে লোহার মালামালগুলো ফেলে চলে যান। পরে সন্ধ্যায় আলমগীর অজ্ঞাত আরও ২০-২৫ জন লোহার রড, অ্যাঙ্গেল ও ছুরি নিয়ে অতর্কিতভাবে নুরুল আলমের ওপর হামলা চালান। নিহত নুরুল আলমের বড় ছেলে মোরশেদুল আলম শিপন বলেন, ‘আমার বাবা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার পাশাপাশি এলাকার মসজিদের সভাপতি ও আগ্রাবাদ অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ কারণে তিনি চোর ও চাঁদাবাজদের পছন্দ করতেন না। তাদের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করায় আমার বাবাকে মেরে ফেলার জন্য পরিকল্পনা করে।’

তিনি বলেন, ‘বাবার ওপর হামলার ঘটনা প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চলেছে। কিন্তু পুলিশের তৎপরতা না থাকায় এখনো একজন আসামি গ্রেফতার হয়নি।’

আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল এলাকায় অধিকাংশ দোকানপাট অস্থায়ীভাবে গড়ে উঠেছে। সেখানে যার পেশিশক্তি বেশি, সেই দোকানদারদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করে। এছাড়া জাম্বুরী মাঠের আশপাশের এলাকায় সড়কের ওপর বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন গাড়ি রাখার জন্য দৈনিক ও মাসিক হারে চাঁদা আদায় করা হয়। এলাকায় বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির ক্ষেত্রেও চাঁদা দিতে হয়। এতদিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এসবের নেতৃত্ব দিলেও ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। ৫ আগস্টের পর একটি পক্ষ আওয়ামী লীগের দখলে থাকা কিছু ভাড়া ঘর ভেঙে সেখানে ২৭নং ওয়ার্ড বিএনপি অফিস তৈরি করে। এরপর সেই অফিস থেকে সব অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আখতার হোসেন বাবলু, কবির, মুসা ও জাহাঙ্গীর। তাদের সঙ্গে যোগ দেন কবিরের ভাই নুরুল আলম, মনা ও হিরু। তারা তিনজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে পট পরিবর্তনের পর তারা এখন বিএনপি নেতা হিসাবে এলাকায় পরিচয় দিচ্ছেন। আগ্রাবাদের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে আগে আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক কাউন্সিলর আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের এবং খোরশেদ আলম (ক্রসফায়ারে নিহত) নেতৃত্ব দিতেন।

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘চুরির প্রতিবাদ করায় নুরুল আলমের ওপর হামলা করা হয়। বিষয়টি দুঃখজনক। নুরুল আলমের মৃত্যুর ঘটনায় যেহেতু মামলা হয়েছে, আশা করছি পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’ আগ্রাবাদে বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিএনপি চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। হাইকমান্ড কোনো অবস্থায়ই চাঁদাবাজি বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম বরদাশত করছে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই কেন্দ্র থেকে সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। তাই চাঁদাবাজি বা মানুষের শান্তি বিনষ্ট করে কেউ বিএনপি বা অঙ্গ সংগঠনে থাকতে পারবে না।’ নুরুল আলমের হত্যাকারীরা গ্রেফতার না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মো. রফিক আহমেদ বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে আসামিরা গা ঢাকা দিয়েছেন। অভিযান চালালেও তাদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। তবে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। চাঁদাবাজি বন্ধেও পুলিশ তৎপর রয়েছে।’

চট্টগ্রাম

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম