Logo
Logo
×

শেষ পাতা

চট্টগ্রামে পরিবহণ খাত

১৬ বছরে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি

Icon

শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৬ বছরে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি

চট্টগ্রামে পরিবহণ খাত থেকে একটি চক্র চাঁদাবাজির মাধ্যমে ১৬ বছরে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নের নামে শক্তিশালী সিন্ডিকেট বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস টেম্পো-টেক্সি, মিনিবাসসহ বিভিন্ন যানবাহন থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। সিন্ডিকেটে পরিবহণ শ্রমিক নামধারী ২০০ জন জড়িত। লাইন পরিচালনা, প্রশাসন ম্যানেজ করা এবং শ্রমিককল্যাণের নামে বিভিন্ন নিবন্ধিত, অনিবন্ধিত ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে তারা চাঁদা আদায় করে। তবে চাঁদার এক কানাকড়িও শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যবহার করা হয়নি। ভুক্তভোগীরা জানান, করোনা মহামারির সময়ও শ্রমিকরা কোনো টাকাপয়সা পাননি।

বাংলাদেশ পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের আওতাধীন বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে পরিবহণ চাঁদাবাজরা ১৬ বছর সাধারণ পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকদের একপ্রকার জিম্মি করে চাঁদা আদায় করে। বিভিন্ন সময় র‌্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে পরিবহণ চাঁদাবাজদের অনেকে হাতেনাতে ধরা পড়লেও অদৃশ্য শক্তির কারণে তাদের বিচার হয়নি। উলটো চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেকে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন।

হত্যা-গুমের হুমকি নিয়ে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবহণ চাঁদাবাজদের গ্রেফতার এবং তাদের হাত থেকে পরিবহণ খাতকে রক্ষা করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকরা। তারা জানান, ১৬ বছর ধরে দানবীয় কায়দায় চেপে বসা পরিবহণ চাঁদাবাজদের গ্রেফতার ও শাস্তি নিশ্চিত না হলে কেবল পরিবহণ শ্রমিক মালিকরাই নন, এর খেসারত দিতে হবে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী লাখ লাখ যাত্রীকেও। কারণ, যাত্রীদের ওপর বাড়তি ভাড়া চাপিয়ে দিয়ে বিশাল অঙ্কের চাঁদার টাকা জোগান দেওয়া হয়।

২৫ নভেম্বর নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানায় পরিবহণ চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ১৬ বছরে কীভাবে কোন রুট থেকে কত টাকা চাঁদা আদায় করা হয়েছে, কারা আদায় করেছেন-এর বিস্তারিত বিবরণ মামলার এজাহারে দেওয়া হয়েছে। পরিবহণ শ্রমিক নেতা শাহ জাহান মামলা করেছেন। মামলায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ও সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খানকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি মোহাম্মদ মুছাসহ ৭২ জন এবং অজ্ঞাতনামা ১২০ থেকে ১৩০ জনসহ ২০২ জনকে আসামি করা হয়েছে। চট্টগ্রামে পরিবহণ খাতে চাঁদাবাজির অভিযোগে কোনো পরিবহণ শ্রমিক নেতার সুনির্দিষ্ট বিবরণসহ মামলা এটাই প্রথম।

মামলার এজাহার ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে পরিবহণ খাতে চাঁদাবাজির ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। অভিযুক্তদের ১৬ বছরের চাঁদাবাজির ফিরিস্তি তুলে ধরে মামলার এজাহারে বলা হয়, চট্টগ্রাম শহরে টেম্পো রুট রয়েছে ২২টি। এসব রুটে বৈধ ও অবৈধভাবে চলাচলরত গাড়ির সংখ্যা ৫ হাজার ২৯৬টি। প্রতিটি গাড়ি থেকে দৈনিক ১৫০ টাকা হারে দৈনিক ৭ লাখ ৯৪ হাজার ৪০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। প্রতি মাসে ২ কোটি ৩৮ লাখ ৩২ হাজার এবং বছরে ২৮ কোটি ৫৯ লাখ ৮৪ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এ হিসাবে ১৬ বছরে কেবল ২২টি রুটে চলাচলরত টেম্পো থেকে ৪৫৭ কোটি ৫৭ লাখ ৪৪ হাজার টাকা আদায় করা হয়।

চট্টগ্রামে বাস-মিনিবাসের রুট ১৮টি রয়েছে। এসব রুটে বৈধ-অবৈধ গাড়ির সংখ্যা ১ হাজার ৯৪১টি। প্রতিটি গাড়ি থেকে দৈনিক ১৫০ টাকা করে ২ লাখ ৯১ হাজার ১৫০ টাকা চাঁদা উঠানো হয়। সেই হিসাবে বছরে ১০ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার এবং ১৬ বছরে ১৬৭ কোটি ৭০ লাখ ২৪ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। একইভাবে চট্টগ্রাম শহরে হিউম্যান হলারের রুট ১৮টি রয়েছে। এসব রুটে বৈধ-অবৈধ গাড়ির সংখ্যা ১৮৬৬টি। এসব গাড়ি থেকে দৈনিক ২০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। বছরে ১ কোটি ১১ লাখ ৯৬ হাজার এবং ১৬ বছরে উঠানো চাঁদার পরিমাণ ১৬৭ কোটি ৭০ লাখ ২৪ হাজার টাকা। চট্টগ্রাম শহরে চলাচলরত ম্যাক্সিমা গাড়ি রয়েছে ২ হাজার ১০০টি। প্রতিটি গাড়ি থেকে দৈনিক ৫০ টাকা হারে চাঁদা নেওয়া হয়। বছরে ৩ কোটি ৭৮ লাখ এবং ১৬ বছরে এসব গাড়ি থেকে চাঁদা উঠানো হয় ৬০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম শহরে নিবন্ধিত সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে ১৩ হাজার। প্রতিটি গাড়ি থেকে দৈনিক ১০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়। এ খাত থেকে বছরে ৪ কোটি ৪৮ লাখ এবং ১৬ বছরে ৭৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে খাত নিয়ন্ত্রণকারীরা।

আন্তঃজেলা বাসটার্মিনাল কদমতলী, অলংকার মোড়, একে খান গেট, দামপাড়া, সিনেমা প্যালেসসহ ২০/২৫টি অস্থায়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে দৈনিক ২ লাখ টাকা করে ১৬ বছরে ১১৫ কোটি ২০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। আরাকান সড়কের বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত চলাচলকারী যানবাহন থেকে দৈনিক ১ লাখ করে ১৬ বছরে ৫৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। অক্সিজেন, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ফটিকছড়ি বাসস্টেশন, শুভপুর বাসস্টেশন, কাপ্তাই রাস্তার মাথা বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন স্ট্যান্ড থেকেও চাঁদার খড়্গ ছিল পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের ওপর।

মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম শহর ও আন্তঃজেলায় চলাচলকারী সব ধরনের গণপরিবহণ ও যানবাহন থেকে ১৬ বছরে ১ হাজার ৩৮১ কোটি ৩৩ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে পরিবহণ খাতের দানবীয় সিন্ডিকেট।

শহরজুড়ে চাঁদাবাজিতে জড়িত বেশ কয়েকজনের নাম মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন মো. আলী, হারুনুর রশীদ, নজরুল ইসলাম, মো. কামাল, খলিলুর রহমান, মো. শফি, ইউনুচ মোল্লা, আমজাদ হোসেন হাজারী, সালাহউদ্দিন ফারুকী, আহমদ হোসেন, আবুল হোসেন, দিলীপ পাল, আলা উদ্দিন, মো. হাসান, শরীফুল ইসলাম তোহা, মো. খোকন, মনজুরুল আলম মনজু, রায়হান, শফিক, সাইফুল, আবুল কালাম আবু, সেলিম টিপু, জিয়াউদ্দিন শরী মিজান, আবদুর রহিম, রুবেল, নুরুল হক পুতু, কাউছার আহম্মদ, আলমগীর, ফারুক, আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী তুহিন, আলমগীর হোসেন, গোলাম মোহাম্মদ, ইউনুচ, জাবেদ, মুরাদ, রাজু, শাহ আলম, বুসু ওরফে বুসা, আলো মিয়া, মফিজ, জাহাঙ্গীর, মোমিন, সেলিম খান, বাবুল, মনছুর আলম, হারুন, জাহেদ হোসেন, জাকির হোসেন, কামরুল জামাল আজিজ, নাজমুল হাসান সুমন, সাইফুদ্দিন আহমেদ, শাকিল, ইলিয়াছ হোসেন লেদু, রিপন আচার্য, সাহাবুদ্দিন সাবু, আবু রাশেদ মুনির, বিপ্লব, আব্বাস, ইদ্রিছ মিয়া, সোলেমান, দিলীপ সরকার, পিনাক কানিহ দাশ, সাদ্দাম হোসেন। এর বাইরে অজ্ঞাতানমা আরও ১২০ থেকে ১৩০ জন রয়েছেন।

সূত্র জানায়, ২ ফেব্রুয়ারি র‌্যাবের ডিএডি শফিকুল ইসলাম পাহাড়তলী থানায় মামলা করেন। পাহাড়তলী অলংকার মোড় এলাকায় বাস, টেম্পো ও সিএনজিচালকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায়কালে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চার আসামি যথাক্রমে পেয়ার আহম্মদ, শফিক, আজিম শরী ও মাসুদকে হাতেনাতে আটক করেন তিনি। এ ঘটনায় ৭ আসামির বিরুদ্ধে পাহাড়তলী থানায় মামলা করে র‌্যাব। হামলা, মারধর, হুমকি-ধমকিসহ বিভিন্ন অভিযোগে নগরীর বিভিন্ন থানায় পরিবহণ চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে বহু মামলা ও জিডি রয়েছে।

মামলার বাদী শাহ জাহান যুগান্তরকে বলেন, আসামিরা পুরো শহরকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে পরিবহণ খাত থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করেছে। এর খেসারত দিতে হয়েছে পরিবহণ মালিক ও সাধারণ শ্রমিকদের। মূলত সরকারের মন্ত্রী এমপি ও প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে ১৬ বছরে চাঁদাবাজির ষোলোকলা পূর্ণ করেছে তারা। এ চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে তাদের হাতে সাধারণ পরিবহণ শ্রমিকরা হামলা, গ্রেফতার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পুলিশ ও র‌্যাব আসামিদের অনেককে চাঁদাবাজির টাকাসহ হাতেনাতে ধরেছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তাদের বেশি দিন জেলে থাকতে হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বিরুদ্ধে মামলাও দেওয়া যায়নি। অটো রিকশা-অটো টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন, হিউম্যান হলার চালক সহকারী ইউনিয়নসহ নিবন্ধিত, অনিবন্ধিত ও নামসর্বস্ব বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে চাঁদাবাজি করা হয়েছে। চাঁদার একটি বড় অংশ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের ঢাকার নেতাদের পকেটে গেছে। তারা এ টাকায় বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, শ্রমিক কল্যাণের নামে চাঁদা তোলা হলেও শ্রমিকদের কল্যাণে চাঁদার টাকার এক কানাকড়িও ব্যবহার হয়নি। এখন সময় এসেছে এ টাকা ফিরিয়ে নেওয়ার।

চট্টগ্রাম টেম্পো মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোতাহের হোসেন মোজাহের যুগান্তরকে বলেন, ১৬ বছরে পরিবহণ খাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজি হয়েছে। শ্রমিক ইউনিয়নের নাম দিয়ে প্রতিটি স্টেশন, প্রতিটি গাড়ি থেকে নানা অসিলায় চাঁদা তোলা হয়েছে। ওয়েবিলের নামে ৫০ টাকার পরিবর্তে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেওয়া হয়েছে। বহদ্দারহাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, আমতলসহ বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের চাঁদা দেওয়ার কথা বলে মালিকের পকেট কেটেছেন শ্রমিকনেতারা।

মামলায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ অলিকে ৭ নম্বর আসামি করা হয়েছে। মামলা প্রসঙ্গে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ফেডারেশনের অধীনে ৪৬টি সংগঠন রয়েছে। মূলত সরকার পরিবর্তনের পর একটি স্বার্থান্বেষী মহল ফেডারেশনের নেতাদের হয়রানির মাধ্যমে পরিবহণ খাত দখলে নিতে এ মিথ্যা মামলা করেছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে গঠনতন্ত্র ও শ্রম আইন মেনে পরিবহণ সেক্টর থেকে চাঁদা তোলা হয়। এ চাঁদার হিসাব চার্টার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অডিট করে শ্রম দপ্তরে হিসাব দেওয়া হয়। যিনি মামলার বাদী হয়েছেন, তিনিও একসময় ফেডারেশনে ছিলেন। করতেন শ্রমিক লীগ। এখন বিএনপি সেজে ফেডারেশনের আওতাধীন প্রতিটি শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছেন। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বারবার সতর্ক করলেও পুলিশ তদন্ত ছাড়াই মিথ্যা মামলা গ্রহণ করেছে। বুধবার সিএমপি কমিশনারের সঙ্গে তাদের বৈঠক রয়েছে। বৈঠকে তারা বিষয়টি উত্থাপন করবেন বলে তিনি জানান।

জানতে চাইলে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি আরিফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, পরিবহণ খাতে চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। তবে এ মামলার বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেননি। খোঁজখবর নিয়ে তিনি পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।

চাঁদাবাজি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম