টঙ্গীর আন্ডারওয়ার্ল্ড-শেষ পর্ব
বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী অস্বস্তি আর আতঙ্ক
অপরাধের সুবিধাভোগী প্রশ্রয়দাতাদের আইনের আওতায় আনতে হবে -ড. তৌহিদুল হক অপরাধ বিশেষজ্ঞ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত টঙ্গীর দুই থানার বাসিন্দারা অনেকটা অস্বস্তি আর আতঙ্ক নিয়েই থাকেন। মাদক, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ তারা।
এসব অপরাধে সক্রিয় রয়েছে অপরাধী চক্র। যারা গৃহহীন ও ঠিকানাবিহীন মানুষের স্রোতে মিশে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে বিষিয়ে তোলে। যে কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষেও তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা যুগান্তরকে জানান, টঙ্গী এলাকায় অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি সামাজিক অপরাধ যেমন নারী নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা, শিশুশ্রম, যৌন হয়রানির মতো বহু অপরাধ ঘটলেও তার অধিকাংশই থানায় রেকর্ড হয় না। ফলে অপরাধীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরাধীদের শনাক্ত ও তাদের অপরাধ প্রবণতার লাগাম টানতে না পারলে পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হতে পারে। তাদের মতে, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে জনগণের সহায়তায় কৌশলগত ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
পুলিশ জানায়, মাদক ব্যবসায়ী, কিশোর গ্যাংসহ ভয়ংকর অপরাধ চক্রের পেছনে এলাকার প্রভাবশালী অনেকেরই মদদ রয়েছে। তারা ব্যক্তিস্বার্থে এসব অপরাধীদের লালন করেন। যে কারণে এদের আইনের আওতায় আনতেও নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
আবার কিছু ভাসমান অপরাধীও এই এলাকায় এসে আশ্রয় নেয়। এদের নাম-পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় প্রায়ই ঘটছে অপরাধমূলক নানা ঘটনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধীদের ধরলেও তাদের কারও কারও পরিচয়পত্র না থাকায় শনাক্ত করা যায় না প্রকৃত ঠিকানা। ফলে নানাভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে পার পেয়ে যায় তারা।
টঙ্গীর ১৯ বস্তিতে অন্তত ৩০০ ঘরকে অপরাধীরা নিজেদের সেকেন্ড হোম হিসাবে ব্যবহার করছে। এসব বস্তি হয়ে উঠেছে চোর-ডাকাত, ছিনতাইকারী ও দাগি অপরাধীদের নীরব আস্তানা। টঙ্গীর অপরাধ জগতে সক্রিয় রয়েছে কিশোরগ্যাংসহ তিন হাজারের বেশি সশস্ত্র ক্যাডার। এরা বিভিন্ন অপরাধের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও ভাড়ায় খাটে।
এছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন করে সক্রিয় হওয়া চাঁদাবাজ, দখলবাজরা এসব অপরাধীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। ১৯ বস্তিসহ অন্তত ৫২টি স্পটে সশস্ত্র প্রহরায় মাদকের পাইকারি ব্যবসা চলছে। মাদক ব্যবসা করে অনেকেই বনে গেছেন বাড়ি-গাড়ির মালিক। লাভবান হচ্ছেন তাদের নেপথ্যের গডফাদাররাও।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা টঙ্গীর জনবসতিকে অপরাধমুক্ত করতে প্রায় এক ডজন পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের মতে, টঙ্গী এলাকার অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সুশীল সমাজকে সমন্বিতভাবে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। অপরাধীদের তালিকা ধরে ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে। এছাড়া এলাকার ভাসমান মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই, যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তাদের সাময়িক পরিচয়পত্র প্রদান করতে হবে।
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে নির্দিষ্ট আবাসনের ব্যবস্থা, যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মের ব্যবস্থা করতে হবে। বস্তিগুলোতে নজরদারি বাড়ানো, রাস্তাঘাট এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা, অপরাধীদের গ্রেফতারের পর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এবং অপরাধীদের পেছনের শক্তিকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হলে নিয়ন্ত্রণে আসবে টঙ্গী এলাকার অপরাধ।
টঙ্গীর বাসিন্দা বাংলাদেশ ফোর্সেস হাসপাতালের সাবেক উপ-অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. নাজিম উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, অপরাধ কমাতে হলে, সমাজে শান্তি ফেরাতে হলে আগে বিনিময় প্রথা বন্ধ করতে হবে। বিনিময় ছাড়া কোথাও কোনো সেবা পাওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, বিনিময় (লেনদেন) ছাড়া নেতাও হওয়া যায় না।
তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যদি একটি দুর্নীতিমুক্ত সরকার গঠন করা যায়, তবে সেই সরকারই পারবে টঙ্গীসহ দেশের অন্যান্য স্থানের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তিনি বলেন, সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে হবে। তাদের মতে, কঠোর মনিটরিং, জনসম্পৃক্ততা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতাসহ সমন্বিত প্রয়াসেই টঙ্গী গড়ে উঠতে পারে নিরাপদ শিল্প নগরী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, যখন কোনো এলাকাতে ভাসমান জনগোষ্ঠী অথবা প্রান্তিক বৈশিষ্ট্যের মানুষের বসাবস বা ঘনত্ব যদি বেশি হয়, সেই এলাকায় নানামুখী অপরাধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। স্থানীয় অপরাধীরা ভাসমান মানুষকে দলে ভিড়িয়ে নিজেদের সিন্ডিকেট আরও মজবুত করে।
তিনি বলেন, টঙ্গীর যেই অপরাধ প্রবণতা, এর নেপথ্যে দুই ধরনের পরিস্থিতি দেখা যায়। এলাকায় যারা বসবাস করেন তাদের দায়িত্বহীনতার কারণেই একটা অংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া যারা অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন তাদের একটি অংশ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, টঙ্গীতে প্রান্তিক অর্থনীতির মানুষের সংখ্যা বেশি, এখানে বস্তির সংখ্যা বেশি। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দুর্যোগ কিংবা রাজনৈতিক কারণে এমনকি ঋণে বিপর্যস্ত হয়ে এলাকাছাড়া মানুষ আশ্রয় নিচ্ছেন। তারা সমাজ স্বীকৃত কোনো আয়ের কিংবা কাজের ব্যবস্থা করতে পারেন না। যে কারণে কখনো একা আবার কখনো সংঘবদ্ধভাবে তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
তাছাড়া কোনো অপরাধ প্রতিরোধে যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা অস্পষ্ট থাকে, তখন অপরাধ বন্ধ করা যায় না বরং অপরাধ নানাভাবে স্থায়ী হয়। তিনি বলেন, এই এলাকার অপরাধী, অপরাধের সুবিধাভোগী ও অপরাধে প্রশ্রয়দাতাদের আইনের আওতায় আনা গেলেই কমে আসবে অপরাধ প্রবণতা।
সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নূরুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, শিল্প এলাকাগুলোতে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের অপরাধীদের তৎপরতা থাকে। টঙ্গীর ক্ষেত্রেও তাই। তিনি বলেন, এই এলাকার অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে। কমিউনিটির সঙ্গে পুলিশের বেশি বেশি সংযোগ স্থাপন করতে হবে। এছাড়া সামাজিক অ্যাওয়ার্নেস বাড়াতে হবে।

