চাঁপাইয়ের নিভৃত গ্রামে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়!
আধুনিক মুসলিম সভ্যতার সূতিকাগার
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বালিয়াদিঘি নিভৃত একটি গ্রাম। গ্রামটির চারপাশ আমগাছের শোভায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এটি ভারত সীমান্তঘেঁষা। তবে বিস্ময়কর হলেও এখানেই রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এটিই দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল আবাসিক। ছিল সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি দারাসবাড়ি মাদ্রাসা নামেও পরিচিত। আরবি দারস অর্থ পাঠ। ওই দারস বা দারুস থেকে মানুষের মুখে মুখে হয়ে গেছে দারাসবাড়ি। আর এ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই অঞ্চলটি আধুনিক মুসলিম সভ্যতার সূতিকাগার হিসাবে গড়ে ওঠে।
শিবগঞ্জের আরেক ঐতিহাসিক স্থান ছোট সোনামসজিদ এবং কোতোয়ালি দরজার মধ্যবর্তী স্থানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। সোনামসজিদ স্থলবন্দরের খুব কাছের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। বিশ্ববিদ্যালয়টির মাত্র দেড়শ গজ পশ্চিমেই রয়েছে আরেকটি প্রত্ন স্থাপনা দারাসবাড়ি মসজিদ। আম্রকাননে বেষ্টিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদটি দেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্মারক। বিশ্ববিদ্যালয়টির অবকাঠামো ইটের তৈরি পুরোনো কাঠামো। পোড়ো জমিদারবাড়ির মতো। বিশ্ববিদ্যালয়টির কাঠামো এখনো দাঁড়িয়ে থাকলেও ধসে গেছে ছাদ ও গম্বুজ। প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এ ঐতিহাসিক নির্দশনটি। ভগ্ন দেওয়াল ও ভূগর্ভস্থ ভিত প্রমাণ করে, এটিই ছিল দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, আনুমানিক ১৪৭৯ সালে সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহের রাজত্বকালে মাদ্রাসা হিসাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। তার আদেশেই সেখানে মাদ্রাসা এবং তৎসংলগ্ন স্থানে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। একটি শিলালিপি বা পাথরে খোদাই করা লেখা থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এসব তথ্য জানতে পেরেছেন। পাথরটির দৈর্ঘ্য ছিল ১১ ফুট ৩ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ছিল ২ ফুট ১ ইঞ্চি। পরে সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের রাজত্বকালে মাদ্রাসাটির সংস্কার করা হয়। ধারণা করা হয়, এর আগে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুধু মাদ্রাসা হিসাবে পরিচালিত হলেও ১৫০২ সালে এটি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। শুধু তাই নয়, আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এটি। শুধুম মুসলিম শিক্ষার্থীরাই পড়তে পারতেন। এজন্যই দারাসবাড়ি মাদ্রাসা হিসাবেও এর পরিচিতি রয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলছেন, এই শিক্ষা ভবনটি ছিল বর্গাকার। মূল গেট ছিল দক্ষিণে। উত্তর এবং পূর্ব দিকেও একটি করে গেট আছে। পশ্চিমে কোনো গেট বা দরজা ছিল না। ভবনের প্রতি পাশের দৈর্ঘ্য ছিল ৫৫.৫ মিটার। বর্গাকার ভবনের মাঝখানে খোলা জায়গা। কেন্দ্রে ছিল একটি বড় কোঠা বা কক্ষ। সম্ভবত ওই কক্ষে মাদ্রাসার প্রধান কর্মকর্তা বা অধ্যক্ষ থাকতেন। তিনিই হয়তো পাশের মসজিদে ইমামতি করতেন। আবার ওখানে গ্রন্থাগার ছিল বলেও উল্লেখ আছে। মসজিদ আর মাদ্রাসার মাঝে ছিল একটি পুকুর। মাদ্রাসা ভবনের চারপাশে ছিল ছোট-বড় অনেক কক্ষ। কক্ষের সংখ্যা ৩৭টি। দেয়ালগুলো পোড়ামাটির ইটের। দেয়ালে ছিল নকশা কাটা অলঙ্করণ। তখনকার আমলে এটিই ছিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসতেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বুখারি এবং মুসলিম শরিফসহ বিভিন্ন হাদিস শিক্ষা দেয়া হতো। মোহাম্মদ বিন ইয়াজদান নামে একজন আলেমকে দিয়ে বুখারি শরিফ হাতে লিখিয়ে নেওয়া হতো। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটি বেশ সমৃদ্ধ ছিল।
সুলতানি আমলের অবসানের পর ধীরে ধীরে নানা কারণে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি গুরুত্ব হারায়। প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সংকটে পড়ে। ধারণা করা হয়, কোন এক প্রবল ভূমিকম্পে বিশ্ববিদ্যালয় ভবনটি মাটির নিচে দেবে যায়। এরপর ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। বছরের পর বছর কেউ এর খবর জানত না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনটি উদ্ধারে চলে খনন কার্যক্রম। খনন শেষে সেখানে মেলে পুরনো ভবনের কাঠামো। উপরের কাঠামো বাদে বেজমেন্টের পুরোটাই আগের রূপ লাভ করে। এর দেওয়ালগুলো অনেক চওড়া এবং মজবুত। পুরো ভবনটি ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত। এটি অনেকটা ব্রিটিশ আমলের ক্যাসেল বা দুর্গের মতো। তবে দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও এটি সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। সম্ভব হচ্ছে না আধুনিকায়নও। এমনকি আবার চালু করারও উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না। সমস্যা হলো, এটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। উত্তর পাশে মাত্র ৫০ গজ দূরে শূন্যরেখা। নিয়ম অনুযায়ী, সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোনো স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। আর তাই এখানে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উল্লেখযোগ্য স্থাপনা তৈরি সম্ভব হয়নি।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড়শ গজ দূরেই রয়েছে দারাসবাড়ি মসজিদ। বিশ্ববিদ্যালয়টির শুধু দেয়ালের নিচের অংশের অবকাঠামো পাওয়া গেলেও, মসজিদের পূর্ণরূপ বিদ্যমান। মসজিদটির ছাদ অনেক উঁচুতে ছিল। মাঝখানে ছিল অখণ্ড প্রাচীন পাথরের পিলার। দেওয়াল ছিল অনেক চওড়া। গম্বুজ ছিল ৬টি। মাঝেরটি ছিল সবচেয়ে উঁচু। দেওয়ালের ওপর দিয়ে অনায়াসে হাঁটা যেত। এটি প্রায় ১০০ ফুট লম্বা। দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত মসজিদের মেঝে। বারান্দা ১০ ফুটেরও বেশি চওড়া। দক্ষিণে তিনটি জানালা ছিল। মহিলাদের নামাজের জন্য পাথরের ওপরে দ্বিতলের মতো আলাদা জায়গা ছিল।
আমবাগান পরিবেষ্টিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থী আসেন। রাজশাহী মহানগর থেকে স্থানটি পরিদর্শনে যান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তারেক সালমান। তিনি বলেন, পরিচর্যার অভাবে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক আকর্ষণীয় স্থাপনা বিলুপ্তির আশঙ্কায় রয়েছে। পুরোনো স্থাপত্যশৈলীর দৃষ্টান্ত স্থাপনা দুটি রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

