সিপিডির গবেষণা
২০২৩-এ কর ফাঁকি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এক দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশে কর ফাঁকির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১১ সালে কর ফাঁকির পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে সেটি দুই লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। করোনাকালীন সময়ে কর ফাঁকির প্রবণতা কম ছিল। আগামীতে করকাঠামো সংস্কার করা না গেলে এ প্রবণতা আরও বাড়তে পারে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে সংস্থার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়। সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সংস্থার জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ।
গত ডিসেম্বরে করপোরেট কর নিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত মোট ১২৩টি কোম্পানির ওপর যৌথভাবে জরিপ চালায় ক্রিশ্চিয়ান এইড ও সিপিডি। এতে তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যাংকিং ও চামড়া-এই পাঁচটি খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। মূল প্রবন্ধে তামিম আহমেদ বলেন, ছায়া অর্থনীতিতে লেনদেন হিসাব কষে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে কর ফাঁকির পরিমাণ দুই লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। এর অর্ধেক করপোরেট কর হিসাব করলে সেটি এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, সাধারণ ব্যবসার অনেক খরচ অনুমোদন না করায় কার্যকরী কর হার গড়ে ৩১-৩২ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে। নিবন্ধিত ৯ শতাংশ কোম্পানি রিটার্ন জমা দেয়। এ কারণে বিদ্যমান কোম্পানির করের বোঝা বাড়ছে। কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় কোম্পানির কর হার কোনো অবস্থাতেই ১৫ শতাংশের নিচে হওয়া যৌক্তিক নয় বলে মনে করেন তিনি।
জরিপের তথ্য তুলে ধরে তামিম বলেন, ৪০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের কর রিফান্ড পেতে সমস্যা হয় না। আর ৪৫ শতাংশ কর্মকর্তাকে রিটার্ন জমা দেয়ার সময় ঘুস চাওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ কর দেয়, তার ৫ শতাংশ ঘুস দেওয়া বা অন্য খরচ হিসাবে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়। এটা বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতিবাজ কর কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধ না করে শুধু করহার পরিবর্তন করলে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদিকে সরকারকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, দুর্নীতি না কমিয়ে কর সংস্কার করা হলে সেটা হিতে-বিপরীত হতে পারে। ব্যবসা খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে। একইভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এখন কর সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু দুর্নীতি কমাতে না পারলে সেটা ব্যবসা বোঝা বাড়াবে।
তামিম বলেন, রিটার্ন জমা না দিলে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে দেখা যেতে পারে। কোম্পানির খরচ অনুমোদন বড় সমস্যা। খরচ অনুমোদন না করায় কার্যকরী করহার খাত ভেদে ৬৬ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। তাই কোম্পানি খরচ কত হবে, সেটা বিবেচনায় নেওয়ার জন্য আয়কর কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, বিশেষজ্ঞ ও হিসাববিদদের নিয়ে একটি কমিটি করা যেতে পারে। প্রতি দুই বছর পরপর এটি রিভিউ করা যেতে পারে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন থেকেই কর ন্যায্যতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। এক্ষেত্রে শুধু প্রগ্রেসিভ কর কাঠামো কর ন্যায্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। কর ন্যায্যতার ভেতরে করহার যেমন রয়েছে; তেমনি কর ভিত্তি, কর ব্যয়, কর ফাঁকি ও কর প্রশাসন রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে করসংক্রান্ত যে কোনো আলোচনায় সবসময় করহার প্রাধান্য পায়। প্রতি বছর বাজেট এলে আমরা দেখতে পাই, প্রেসার গ্রুপ কর কমানোর জন্য চাপ দেয়। এতে সরকারের কর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য প্রায়শই বিচ্যুত এবং খোলস আকারে থেকে যায়, পরিণতিতে ভালো ফল নিয়ে আসে না।
তিনি আরও বলেন, করহার কমিয়ে দিয়েও কর ন্যায্যতা বাস্তবায়ন সম্ভব। যদি কর ফাঁকি রোধ করা যায় এবং কর প্রশাসন কাঠামোয় উন্নতি আনা যায়। একই সঙ্গে কর ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনা যায় এবং করভিত্তি বাড়ানো যায়। কর কাঠামো ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে শুধু এনবিআরের তরফ থেকে অনীহা নয়, ব্যবসায়ীদের দিক থেকেও অনীহা আছে। বাংলাদেশের কর প্রণোদনা কাঠামো পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মন্তব্য করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কর ব্যয় নিয়ে কখনোই অ্যাসেসমেন্ট করা হয়নি। যেই খাতকে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, সেই খাত আদৌ কী উপকারী হয়েছে? কারণ কর প্রণোদনা কখনোই বিনিয়োগের নিয়ামক হতে পারে না। একসময় রাজনৈতিক বিবেচনায় কয়েকটি খাতকে কর প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রভাব থেকে এবং খাতভিত্তিক ঢালাওভাবে প্রণোদনা দেওয়া থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। শুধু নতুন শিল্পকে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত যতগুলো দেশ এলডিসি উত্তরণ করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের কর ভিত্তি সবচেয়ে দুর্বল। এই কর ভিত্তি নিয়ে এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে যেসব চাহিদা তৈরি হবে, সেগুলো কীভাবে সরকার পূরণ করবে? অথচ কর প্রণোদনা দিতে দিতে সামাজিক খাত অবহেলিত থাকছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যে পর্যাপ্ত অর্থ বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। শুধু কর ন্যায্যতা বা এলডিসি উত্তরণের অংশ হিসাবে নয়, সামগ্রিকভাবে এই কর কাঠামোর খোলনলচে পরিবর্তন দরকার এবং সেটা খুব জটিল কিছু নয়। এজন্য কিছু আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং অবকাঠামো উন্নয়ন দরকার।
