Logo
Logo
×

শেষ পাতা

জীববৈচিত্র্য চরম হুমকিতে

বিপন্ন বন্যপ্রাণীর ৪০ শতাংশ সংরক্ষিত এলাকার বাইরে

আবাসস্থল ক্রমেই ধ্বংস হচ্ছে সংঘাত বাড়ছে বণ্যপ্রাণী ও মানুষের * উপকূলীয় এলাকার জীববৈচিত্র্যও সংরক্ষিত নয়

হক ফারুক আহমেদ

হক ফারুক আহমেদ

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিপন্ন বন্যপ্রাণীর ৪০ শতাংশ সংরক্ষিত এলাকার বাইরে

বিলুপ্ত হওয়ার চরম হুমকিতে আছে বিপন্নের কাতারে চলে যাওয়া দেশের অনেক বন্যপ্রাণী। নষ্ট হওয়ার পথে জীববৈচিত্র্য। স্থল, নদী বা সমুদ্র সব জায়গায় একই অবস্থা বিরাজমান। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, দেশের বিপন্ন বণ্যপ্রাণীর ১২৫টির মধ্যে ৪০ শতাংশের বসবাস এখনও সংরক্ষিত এলাকার বাইরে। অর্থাৎ বনবিভাগের আওতাধীন জায়গা বা বনের বাইরেও দেশের বিশাল এলাকাজুড়ে অরক্ষিত অবস্থায় এসব বন্যপ্রাণী, পাখি, জলজ প্রাণীদের বসবাস রয়েছে। এলাকাগুলোতে বিপন্ন সব বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। মানুষের সঙ্গে তাদের সংঘাত বাড়ছে। বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক আবাসস্থল নষ্ট করতে করতে এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে, প্রাণীদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল নেই বললেই চলে। ফলে দেশে এক সময় প্রচুর পাওয়া বা দেখা যেত এমন অনেক প্রাণী এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। বনজঙ্গল নষ্ট করা, জলাভূমি ভরাট হওয়া, পরিবেশ দূষণ, নির্বিচারে শিকার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও দেশে অনেক প্রাণীকূল এখন বিপন্ন।

দেশে বিপন্ন প্রাণীগুলোর মধ্যে আকারে বড় প্রাণী বেশি। কারণ বড় আকৃতির প্রাণীগুলোর জন্য অনেক বেশি পরিমাণ আবাসস্থল প্রয়োজন। এ প্রাণীগুলোর সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্বও বেশি। যেমন বাঘ, হাতি। আরও আছে রাজগোখরাসহ কয়েক প্রজাতির সাপ। এগুলোর সবই খুবই বিপন্ন অবস্থায় আছে। বনরুই ভীষণভাবে বিপন্ন। আছে মেছো বিড়াল, বুনো খরগোশ, ঘড়িয়াল, মিঠা পানির কুমির। কাছিমের দু-তিনটি জাত ছাড়া বাকি সব-ই বিপন্ন। পাখিদের মধ্যে মদনটাক, শকুন, কয়েক প্রজাতির ঈগল ছাড়াও আছে আরও অনেক প্রজাতির পাখি।

বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ ও তরুণ গবেষক আশিকুর রহমান সমি তার সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ১২৫টি বিপন্ন বন্যপ্রাণীর মধ্যে ৪৯টি (১৯টি বর্গ এবং ৩১টি পরিবারের অধীন) সুরক্ষিত এলাকার বাইরে পাওয়া গেছে। যা শতকরা হিসাবে প্রায় ৩৯.২ ভাগ। এতে বলা হয়েছে, বিষটি উদ্বেগজনক। কারণ সে হিসাবে দেশের বিপন্ন প্রজাতির দুই-পঞ্চমাংশের বসবাস সংরক্ষিত এলাকার বাইরে।

আশিকুর রহমান সমি যুগান্তরকে বলেন, সংরক্ষিত এলাকা হলো আইন দ্বারা বা বনবিভাগের নিয়ন্ত্রিত এলাকা যেখানে সেখানকার জীববৈচিত্র্য, উদ্ভিদ, প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়। অসংরক্ষিত এলাকার বাইরের সাধারণ জমিজমা সবই। সংরক্ষিত এলাকার বাইরে এসেও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। মানুষ বণ্যপ্রাণীদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল নষ্ট করতে করতে এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে, প্রাণীর জন্য নিরাপদ আবাসস্থল নেই। সংঘাত বাড়ছে বণ্যপ্রাণী ও মানুষের।

তিনি বলেন, সংরক্ষিত এলাকার বাইরের বিষয়ে এতদিন চিন্তাভাবনা কম ছিল। গবেষণা করলেও বনের ভেতরের বন্যপ্রাণী নিয়েই ছিল। কিন্তু সংরক্ষিত এলাকার বাইরেও বিপন্ন বন্যপ্রাণীর বসবাস অনেক। বৃহত্তর খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে সীমান্ত এলাকায় অনেক বিপন্ন বন্যপ্রাণী পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে কোনো সংরক্ষিত এলাকা নেই। মদনটাক, শিয়াল, মেছোবিড়াল, মানিকজোড়, বিভিন্ন প্রকার হাঁস, জলাভূমিকেন্দ্রিক বিপন্ন ও বিরল পাখি আছে এসব এলাকায়। নদীতে ডলফিন, যশোরের কেশবপুরে হনুমান পাওয়া যাচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ রাজশাহীর বেশ কিছু বিলে, মহানন্দা নদীর আশপাশে অনেক বিরল পাখি পাওয়া যাচ্ছে। বিলুপ্ত হওয়া পাখি ‘ধূসর তিতির’ পাওয়া গেছে। পঞ্চগড়ে পাওয়া গেছে সবুজ ময়ূর যেটি বিলুপ্ত ছিল। সিলেট বা চট্টগ্রামে যে পাহাড়ি বনাঞ্চল সেখানে অনেক সংরক্ষিত এলাকা আছে, কিন্তু এসব এলাকায় নেই। তিনি আরও বলেন, ২০১৬ সাল থেকে বৃহত্তর যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া এলাকায় কাজ করেছি। দেশে ২৬৫ প্রজাতির পাখি আছে। যার মধ্যে বিপন্ন প্রজাতির পাখির সংখ্যা ৩৮টি। শুধু ওই অঞ্চলেই আমি পেয়েছি ২০ প্রজাতির পাখি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, শুধু এই এলাকায় যদি এত প্রজাতির বিপন্ন পাখি থাকে তাহলে কেন তাদের সংরক্ষণ করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান যুগান্তরকে বলেন, প্রাকৃতিকভাবেই বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ছিল। যেহেতু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় আমাদের অবস্থান। আয়তনের তুলনায় অনেক বেশি জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ। প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস এবং মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের কারণেই বন্যপ্রাণীর অনেকেগুলোই এখন বিপন্ন পর্যায়ে চলে গেছে। বনজঙ্গল পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, জলাভূমি ভরাট হচ্ছে। বন্যপ্রাণীর নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার করার জন্য শিকার করা হচ্ছে। কালোবাজারে বাঘ বা হাতির শরীরের নানা অংশ, হাতির দাঁত বিক্রি করে এরা। বেশি দামে বিক্রি হয় বনরুইও। অনেকে আবার শুধু মাংসের জন্যও শৌখিন বা বংশপরম্পরায় শিকার করে। পাখি শিকার চলে।

তিনি বলেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো অবস্থা। সব মিলিয়ে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলমান। তবে বড় কথা এখনো যেটি আছে তা কম নয়। কিন্তু সেটাকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে সঠিক ব্যবস্থা যদি না নেওয়া হয় তাহলে যা আছে সেটাও থাকবে না। তিনি আরও বলেন, যেসব প্রাণী বিপন্ন হয়ে গেছে তাদের সব রক্ষিত এলাকায় নেই। আবার রক্ষিত এলাকাতে থাকলেই যে পুরোপুরি সুরক্ষিত এমনটাও নয়। কারণ, রক্ষিত এলাকাগুলো আইনগতভাবে রক্ষিত কিন্তু সেখানেও যে সংরক্ষণ পুরোপুরি বিরাজমান তা বলা যাবে না। সেখানেও নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড, গাছ কাটা বা শিকারের কারণে বন্যপ্রাণীর জীবনযাপন ধ্বংস হচ্ছে। যার জন্য প্রথমে সংরক্ষিত এলাকাগুলোকেও ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।

বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল বিশেষ করে জলাভূমির একটি বড় অংশ রক্ষিত এলাকার বাইরে রয়ে গেছে। সেখানেও বন্যপ্রাণী বা জীববৈচিত্র্য আছে। সেখানেও উদ্যোগ দরকার। সংরক্ষিত এলাকার বেশিরভাগই বন নির্ভর, বনবিভাগের আওতাধীন জায়গা। কিন্তু আমাদের জীববৈচিত্র্য একেকরকম আবাসস্থলে একেক রকম। উপকূলীয় বা সমুদ্র এলাকায় যে জীববৈচিত্র্য আছে সেটাও সংরক্ষিত নয়। তাই সব ধরনের আবাসস্থলেরই সমৃদ্ধ কিছু এলাকা সংরক্ষিত কিছু এলাকার মধ্যে সংযোজিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেখানে প্রকৃতপক্ষেই যেন জীববৈচিত্র্য বা বন্যপ্রাণী নিরাপদে থাকতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু আইনগতভাবে রক্ষিত হলেও হবে না।


Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম