ঈসা খাঁর শৌর্য-বীর্যের স্বাক্ষর জঙ্গলবাড়ি দুর্গ
এটিএম নিজাম, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ নাম বীর ঈসা খাঁ। ভাটি বাংলার স্বাধীন বীর বারভূঁইয়া প্রধান মসনদে আলা ঈসা খাঁর শৌর্য-বীর্যের সোনালি স্বাক্ষর জঙ্গলবাড়ি দুর্গ এখনো দর্শনার্থী-পর্যটকদের আকর্ষণ। দেশের দূর-দূরান্ত এমনকি দেশের বাইরে থেকেও অনেক পর্যটক আসেন এখানে। কিন্তু সীমাহীন অযত্ন-অবহেলায় জৌলুস হারাতে বসেছে ঈসা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত তার দ্বিতীয় রাজধানীখ্যাত কিশোরগঞ্জের পরিখাবেষ্টিত দুর্ভেদ্য জঙ্গলবাড়ি দুর্গবাড়ি।
ইতিহাসের সাক্ষী এই ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে প্রতিদিনই দেশ-বিদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনপ্রেমীরা এসে হতাশ হয়ে ফিরে যান। তবে দীর্ঘদিন ধরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ ঐতিহাসিক নিদর্শনের সামনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখে দায়িত্ব শেষ করলেও এবার প্রকৃত অর্থে সংস্কার-সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণের কাজও শুরু করার খবর মিলেছে। একই সঙ্গে খননকাজের মাধ্যমে শুরু হয়েছে ধসে পড়া ভূগর্ভস্থ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধারকাজ।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলবাড়ি দুর্গ সরেজমিন পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে এমন পদক্ষেপের সত্যতা মিলেছে।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ বিভাগে যোগাযোগ করা হলে ভূমি অধিগ্রহণ কাজ শেষ পর্যায়ে বলে তথ্য মেলে। আর এসব কাজে প্রায় ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান বলেন, অধিগ্রহণ কাজে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরাধিকার সূত্রে ভূমি মালিকদের ক্ষতিপূরণের চেক প্রদানের কাজ শিগগিরই শেষ হবে।
ঈসা খাঁ ১৫২৯ সালের ১৮ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সোলায়মান খাঁ। তিনি ছিলেন আফগানিস্তানের সোলায়মান পার্বত্য অঞ্চলের এক আফগান দলপতির বংশধর। মুঘলদের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ বঙ্গদেশের তৎকালীন কয়েকজন জমিদার প্রেরিত গোয়েন্দা মারফত বঙ্গদেশে আসার আমন্ত্রণ পান ঈসা খাঁ। একপর্যায়ে তিনি ১৪০০ ঘোড়সওয়ার ও গোলাবারুদ নিয়ে বঙ্গদেশের উদ্দেশে ত্রিপুরা রাজ্যে এসে পৌঁছান। ১৫৮৫ সালে তৎকালীন কোচ সামন্ত রাজা লক্ষ্মণ হাজরা ও রাম হাজরাকে পরাজিত করে তিনি জঙ্গলবাড়ি দুর্গ দখল করেন। কোচ রাজা লক্ষ্মণ হাজরা বা ঈসা খাঁ কেউ এ দুর্গের স্থপতি নন। এটি প্রাক-মুসলিম যুগে নির্মিত বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা। তবে ঈসা খাঁ দুর্গ দখল করার পর এর ভেতরে কিছু স্থাপনা নির্মাণ করেন। যার চারপাশে ছিল ‘আরা’ নামের জলাধারবেষ্টিত দুর্ভেদ্য পরিখা।
১৫৯৭ সালে তিনি পাকুন্দিয়ার এগারসিন্দুরে মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে মুখোমুখি তলোয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সে যুদ্ধে ঈসা খাঁর তলোয়ারের প্রচণ্ড আঘাতে মানসিংহের তলোয়ার দ্বিখণ্ডিত হয় এবং মানসিংহ পরাজিত হন। এ দুর্গ থেকে পরে তিনি ২২টি পরগনা দখল করেন। ত্রিপুরা রাজ্য থেকে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি দুর্গ দখল করে পরে সোনারগাঁ দুর্গও দখল করেন। তিনি তার দুরন্ত যৌবনকাল ভাটি বাংলাতেই কাটিয়েছিলেন। তবে এর আগে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার কাস্তুল নামক স্থানে মুঘল সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে নিহত হন ঈসা খাঁর ছেলে মাসুম খাঁ। এ যুদ্ধ ইতিহাসে ‘ব্যাটল অব কাস্তুল’ হিসাবে খ্যাত।
ঈসা খাঁর প্রথম রাজধানী সোনারগাঁয়ের প্রাচীন নাম ছিল সুবর্ণ গ্রাম। ঈসা খাঁ রাজা চাঁদ রায়ের কন্যা, কেদার রাজার বোন স্বর্ণময়ীকে বিয়ে করেন। স্বর্ণময়ী পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ঈসা খাঁ তার নাম রাখেন সোনাবিবি। মসনদে আলা বীর ঈসা খাঁর দুর্গ বাড়ির দৃষ্টিনন্দন মসজিদটিও তৈরি হয়েছিল তার আমলেই। দুর্গের চারদিকে আরা নামে জলাধারবেষ্টিত দুর্ভেদ্য পরিখা খনন করা হয় মুঘল আক্রমণ ঠেকানোর জন্য। পরিখাটি ছিল বৃত্তাকার। দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিকে গভীর পরিখা খনন এবং পূর্বদিকে নরসুন্ধা নদীর সঙ্গে এর সংযোগ স্থাপন করা হয়। তবে সেই দুর্ভেদ্য পরিখা আরা ও আশপাশের অনেক সম্পত্তি ইতোমধ্যেই গ্রাস করেছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী ভূমিদস্যু চক্র। এই দুর্গটির ছাদ ধসে গেলেও দরবার কক্ষের দরবার এবং পান্থশালায় এখনো ১০-১২টি কক্ষের অস্তিত্ব রয়েছে। এর আগে এখানে ৪০ কোঠার একটি বিশাল অন্দরমহল ও সুরম্য দরবার হলও ছিল। কালের রুদ্ররোষে আজ ওইসব শুধুই স্মৃতি।
