Logo
Logo
×

শেষ পাতা

সেমিনারে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা

সাংবাদিকদের নামে ঢালাও মামলায় সরকার বিব্রত

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ক্ষমতার পালাবদলের পর সাংবাদিকদের নামে ঢালাও হত্যা মামলা হচ্ছে। মূল যে অভিযোগ, সেটা দিয়ে মামলা হয় না। বিষয়টি নিয়ে সরকারও বিব্রত। তার মতে, মামলা বাণিজ্য দেশের পুরোনো সংস্কৃতি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মামলা দেয়। আর বর্তমানে ক্ষমতা শুধু সরকারে সীমাবদ্ধ নেই। ক্ষমতার ভর কেন্দ্র অনেক। রোববার রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত সেমিনারে এসব কথা বলেন তিনি।

দেশে অবশ্যই গোয়েন্দা সংস্থার দরকার আছে বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। কিন্তু তাদের ‘ম্যান্ডেড’ কতটুকু, তা বুঝতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের এসব ‘সিক্রেট এজেন্সি’ গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপ করে। ৫ আগস্টের পর সেখানে কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের সংস্কার হয়নি। তাই মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এসব সংস্থায় সংস্কার জরুরি।

এ সময়ে গত ১৫ বছরে গণমাধ্যমে গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপ নিয়ে কথা বলেন সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াবের সভাপতি একে আজাদ ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষ্যে যৌথভাবে এই সেমিনার আয়োজন করে ইউনেস্কো ঢাকা অফিস, টিআইবি ও সুইডেন দূতাবাস। সেমিনারের বিষয় ছিল : ‘সাহসী নতুন বাংলাদেশ : গণমাধ্যমের স্বাধীনতার রোডম্যাপ সংস্কার।’ অনুষ্ঠানে জানানো হয়, শিগগিরই গণমাধ্যম সুরক্ষা আইন পাশ হবে। এছাড়াও বাড়ানো হবে পত্রিকার বিজ্ঞাপনের রেট। যেসব মিডিয়া অতিরিক্ত প্রচার সংখ্যা দেখাচ্ছে, তাদের তথ্য উন্মোচন করা হবে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস লিনাস রাগনার উইকস, এএফপির ব্যুরো চিফ শেখ সাবিহা আলম এবং বিজেসির চেয়ারম্যান রেজোয়ানুল হক রাজা। মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন এমডিআইর নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান মুকুর, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী এবং যুগান্তরের বরিশাল ব্যুরো প্রধান আকতার ফারুক শাহিন প্রমুখ। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ভালো সাংবাদিকতার জন্য অবশ্যই সাংবাদিকদের বেতন বাড়াতে হবে।

তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমের যারা নীতিনির্ধারক আছেন, যেখান থেকে তাদের নিউজ বা মতামত তৈরি হয়, তাদের অবশ্যই প্রশ্ন করার সুযোগ থাকা উচিত। বিটিভি, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ও বাংলাদেশ বেতারকে একত্র করে একটি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার পক্ষে থাকার কথা জানিয়ে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এক করার পক্ষে। তবে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে আরও আলোচনা হতে পারে।’ সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন তাৎক্ষণিকভাবে করা সম্ভব। মাহফুজ আলম বলেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনে ‘ওয়ান হাউজ ওয়ান মিডিয়া’ যে নীতির কথা বলা হয়েছে, তা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইনের কিছু কিছু ধারা নিয়ে কমিশনের সঙ্গে বসা দরকার, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পাঠানো দরকার কোনো দুর্বলতা আছে কিনা জানার জন্য। এটুকুর জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি। এরপর আমরা এটি কেবিনেটে তুলব। আইন আকারে যেন আসে, চেষ্টা করব। বিজ্ঞাপনের হার পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে একমত জানিয়ে মাহফুজ আলম আরও বলেন, ডিএফপিতে এটা বাড়ানোর আলোচনা করেছি। ডিএফপির সঙ্গে টাস্কফোর্স গঠন করেছি। বর্তমানে পত্রিকায় সরকারি বিজ্ঞাপনের যে রেট, তা ২০১৪ সালে নির্ধারণ করা। ওই সময়ের তুলনায় মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে বিজ্ঞাপনের রেট বৃদ্ধি করা জরুরি। তিনি বলেন, যেসব পত্রিকার প্রচার সংখ্যা দুই হাজারও না, কিন্তু এক লাখ, দুই লাখ দেখিয়ে রাষ্ট্রের টাকা লুটপাট করেছে। তাদের তথ্য উন্মোচন করা হবে। অধিকাংশ হাউজের এই পলিসি নেই যে, রাষ্ট্রকে ট্যাক্স দেবে। তার মতে, স্বৈরাচার সরকারের সময়ের গণমাধ্যমগুলোর কার্যকলাপ নিয়ে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং দরকার। বাংলাদেশের মিডিয়ায় দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা জরুরি। রাজনীতিকরণ করার কারণে গণমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকরাই বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

মাহফুজ আলম বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ আছে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। গত ১৫ বছর যে ক্ষোভ আছে, সেটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে সেটা আমরা এবং পুরো বাংলাদেশের পলিটিক্যাল সিস্টেম ঠিক করতে ব্যর্থ হয়েছি। যার বিরুদ্ধে সঠিক অভিযোগ আছে, সেই অভিযোগে মামলা হয়নি। হয়েছে হত্যা মামলা। এটা নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছি।

আমরাও বারবার বলার চেষ্টা করছি। আইন মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এটা একটা জায়গায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। মামলা হওয়া ও আইনি ব্যবস্থা দুটো ভিন্ন বিষয়। মামলা যে কেউ করতে পারে। সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে। সরকার অন্যায়ভাবে কাউকে গ্রেফতার করছে কিনা, সেখানে কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। মামলা বাণিজ্যকে পুরাতন সংস্কৃতি উল্লেখ করে মাহফুজ আলম বলেন, এখন ক্ষমতা শুধু সরকারে নেই। ক্ষমতার ভর কেন্দ্র অনেক। অনেক ধরনের রাজনৈতিক দল ক্ষমতার ভর কেন্দ্রে আছে। সব ধরনের ভর কেন্দ্র সামলে সরকার চালাতে হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মামলা দেয়। স্থানীয়ভাবে মামলা বাণিজ্য বাংলাদেশে নতুন কোনো সংস্কৃতি না। এটা বন্ধ করতে হলে সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তথ্য উপদেষ্টা বলেন, মানুষ সব কিছু লিখতে পারছে। তিনি আরও বলেন, আমরা কিছুই করতে চাই না। সংবাদমাধ্যম যা ইচ্ছা লেখার অধিকার রাখে। সংবাদমাধ্যমকে অবশ্যই প্রশ্ন করতে হবে। যত বেশি সংবাদমাধ্যম প্রশ্ন করে রাষ্ট্রের ভেতর দায়িত্বশীল যারা আছে, তারা আরও বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করতে বাধ্য। সংবাদমাধ্যমকে প্রশ্ন করতে হবে, প্রশ্ন তুলতে হবে। কিন্তু এটার পদ্ধতি কি, এটা কীভাবে কাজ করবে, জবাবদিহি করাটাই কি মুখ্য নাকি আসলে তাদেরও ১০টা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে, এটা ভাবা দরকার। কিন্তু প্রশ্ন করা দরকার, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকেও প্রশ্ন করতে হবে। আমাদের সরকার প্রশ্ন নিতে রাজি আছে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের ‘সিক্রেট এজেন্সিস’ খবরে হস্তক্ষেপ করেছে। ৫ আগস্টের পর সেখানে কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের সংস্কার হয়নি। সেখানে সংস্কার জরুরি।

কামাল আহমেদ বলেন, ন্যায্য পারিশ্রমিক ও নীতিগত সহায়তা সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে জরুরি। সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম উভয়ে আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা তাদের আপস করতে বাধ্য করছে। তিনি বলেন, ‘স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য বিদ্যমান বৈরী পরিবেশের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সাংবাদিকদের ওপর মৌখিক ও শারীরিক হামলা এখনো হচ্ছে। অনেকে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ কারাবন্দি হয়েছেন, তবে তা তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য। তারা একই সঙ্গে সাংবাদিক, আবার রাজনৈতিক কর্মী।’ গণমাধ্যমের সেলফ সেন্সরশিপ ও সাংবাদিকদের ওপর বেশির ভাগ হামলার পেছনে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুমকি এবং কথিত মব ভায়োলেন্স কাজ করছে। সরকারের এগুলো কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণের কথা থাকলেও তা দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের বিনিয়োগ বৈধ উৎস থেকে এসেছে কিনা, তা জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে কালোটাকা ব্যবহৃত হয়েছে। পরিণতিতে সংবাদমাধ্যম হয়ে উঠেছে একেকটি গোষ্ঠীর হাতিয়ার, যার মাধ্যমে তারা তাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে প্রশ্নের বাইরে রাখতে বা সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। কামাল আহমেদ বলেন, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজের দপ্তর থেকে পাওয়া আর্থিক বিবরণীতে দেখা গেছে, দেশে দেড় ডজনের বেশি সংবাদমাধ্যম লাভজনক। এটা প্রমাণ করে, গণমাধ্যমকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা মোটেও অযৌক্তিক নয় এবং তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সম্প্রতি একজন উপদেষ্টাকে বিতর্কিত প্রশ্ন করার পর তিনটি আলাদা প্রতিষ্ঠানের তিনজন সাংবাদিককে বরখাস্ত করার ঘটনায় কামাল আহমেদ বলেন, ‘কোনো আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়াই এ ধরনের চাকরিচ্যুতিকে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে এটি কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ ছিল কিনা।’ তিনি বলেন, সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম উভয়ে আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা তাদের আপস করতে বাধ্য করছে। সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস লিনাস রাগনার উইকস বলেন, ‘এখনো গণমাধ্যমকর্মীরা বলছেন, তারা মুক্তভাবে কাজ করতে পারছেন না। অনেক প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে ফিল্টারিং করছেন। তারমতে, অনলাইনে ভুল তথ্য ও প্রোপাগান্ডা মোকাবিলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি বলেন, গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের কিছুটা এগিয়ে আসা ইতিবাচক। তবে ‘গণমাধ্যমে নারীদের সুষ্ঠু কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মুক্ত গণমাধ্যম ছাড়া মানবাধিকার নিশ্চিত করা যাবে না। ‘যখন সাংবাদিকের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়, তখন তার সঙ্গে সাধারণ জনগণও বাকস্বাধীনতা হারায়।’

একে আজাদ বলেন, বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকতার অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ ১৬ ধাপ এগিয়েছে। আগে কথা বলার অবস্থা ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে ৩২ ধাপ পেছাব না, এ নিশ্চয়তা কে দেবে। তিনি বলেন, প্রেস কাউন্সিল একটি পঙ্গু প্রতিষ্ঠান। এর কোনো ভূমিকা নেই। পুরোপুরি সরকারের আজ্ঞাবহ। তিনি আরও বলেন, আপনার-আমার নিরাপত্তা দেবে কে? একজন সাংবাদিক অপরাধ করলে তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেলে মারা যেতে হবে কেন। মুশতাক আহমেদকে কেন জীবন দিতে হয়েছে? কী অপরাধ ছিল তার? এটি নিয়ে কেউ কখনো কথা বলেছি? কথা বলার অবস্থা ছিল না। নোয়াব সভাপতি আরও বলেন, একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম