ফ্যাসিস্টদের বাঁচাতে বিটিআরসির হঠকারী সিদ্ধান্ত
আইওএফ বাতিলে ৩০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে
বিটিআরসির এই সিদ্ধান্ত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভুল বার্তা দেবে * অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে লুট করা ৯২১ কোটি টাকা উদ্ধার ও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আন্তর্জাতিক গেটওয়ে অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ) বাতিলে হুমকির মুখে পড়েছে আইজিডব্লিউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে) খাতের ৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। গত সরকারের সময় এ খাতের ৯২১ কোটি টাকা লুটে জড়িত সালমান এফ রহমানসহ ৬ আইজিডব্লিউ কোম্পানির মালিক ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। অভিযোগ উঠেছে, গত সরকারের প্রভাবশালী টেলকো ব্যবসায়ীদের ফের অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যে ফিরিয়ে আনতে কৌশলে আইএফও বাতিলের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে লুটপাটকারীদের আইনের হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ২০১২ সালের পর ৬টি আইজিডব্লিউ কোম্পানির একটি সিন্ডিকেট ইন্টারন্যাশনাল কল টার্মিনেশনের মাধ্যমে ৯২১ কোটি টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। তখন শুধু লুটতরাজই নয়, পুরো ইন্টারন্যাশনাল কল টার্মিনেশন সেক্টরে এক অরাজক অবস্থা তৈরি হয়েছিল। যে যেভাবে পেরেছে অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়েছে। সরকার হারিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। নিজস্ব জনবল ও ইকুইপমেন্ট না থাকায় খোদ বিটিআরসিও তখন অসহায় ছিল। একপর্যায়ে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক গেটওয়ে অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ)। এরপর আস্তে আস্তে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কলে শৃঙ্খলা আসে। লুটপাটের কিছু টাকাও ফেরত আনা সম্ভব হয়। প্রভাবশালী ও বিতর্কিতদের একক রাজত্ব ও সিন্ডিকেট ভেঙে দেয় আইওএফ। সরকারের রাজস্বও বাড়তে থাকে।
কিন্তু সম্প্রতি বিটিআরসির ওই সিন্ডিকেট ফের লুটপাটের পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা পুরোনো লুটপটকারীদের নিয়ে নতুন সিন্ডিকেট তৈরির পাঁয়তারা করছে। অভিযোগ উঠেছে, এতে আইওএফ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তড়িঘড়ি করে ভেঙে দেওয়া হয় এই সংগঠন।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ আইওএফ বাতিল হওয়ায় বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানসহ পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৯২১ কোটি টাকা লুট করা ৬ আইজিডব্লিউ কোম্পানির মালিকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। লুটপাট হওয়া টাকাও উদ্ধার করা যাবে না। শুধু আইজিডব্লিউ কোম্পানির মালিকরাই নয়, বেঁচে যাবে খোদ বিটিআরসি‘র আওয়ামী লীগপন্থি অর্ধশত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীও। তাদের অভিযোগ, বিটিআরসির হটকারী এই সিদ্ধান্তের ফলে হুমকির মুখে পড়বে ২৩টি আইজিডব্লিউ কোম্পানির ৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। একই সঙ্গে অরাজক অবস্থা তৈরি হবে আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আইওএফ-এর টপোলজি বাতিল করে পুরো টেলকো খাতকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়েছে বিটিআরসি।
আইওএফ নেতারা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) এই সিদ্ধান্তে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, এটি বাতিলের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। সংশ্লিষ্টদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগও দেওয়া হয়নি।
আইওএফ প্রেসিডেন্ট আসিফ রব্বানি বলেন, ‘বিটিআরসি কোনো ধরনের পূর্ব আলোচনা ছাড়াই চুক্তি বাতিল করেছে এবং আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়নি। এটি অত্যন্ত হতাশাজনক এবং অবিবেচনাপ্রসূত। অন্তত একটি শোকজ নোটিশ পেলেও তারা অভিযোগের জবাব দিতে পারতেন।
অংশীজনের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়া অনেকটা লুকোচুরি ও তড়িঘড়ি করে নেওয়া এই সিদ্ধান্তকে তিনি উদ্দেশ্যমূলক ও বিনিয়োগ বিরুদ্ধ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার যখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে তখন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার এই সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের ভুল বার্তা দেবে।
আসিফ রব্বানি দাবি করেন, আইওএফ গঠনের আগে ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ৬টি আইজিডব্লিউ যেখানে প্রায় ৯২১ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছিল। ২০১৫ সালে আইওএফ গঠনের পর থেকে রাজস্ব খাতে মোট ৫,৬০৭ কোটির বেশি টাকা জমা হয়েছে। যার মধ্যে ৪,৩৪২ কোটি রাজস্ব অংশীদারিত্ব, ৬৩৫ কোটি লাইসেন্স ফি এবং ৬৩০ কোটি টাকার ভ্যাট ও অগ্রিম আয়কর রয়েছে। কাজেই এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগঠনকে কোনো কিছু না জানিয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার একতরফা সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
অভিযোগ রয়েছে, বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো কম্পিউটারের সঙ্গে বিটিআরসির অনুমোদনে তদানীন্তন আইওএফ’র সঙ্গে চুক্তি হয়। এর সঙ্গে বিটিআরসির অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। এসব রাঘববোয়ালের হাত দিয়েই মূলত এমডিএস ফান্ডের মাধ্যমে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা চলে যায় সালমান রহমানের প্রতিষ্ঠানে। অভিযোগ আছে, এ টাকা থেকে অল্প কিছু অর্থ ব্যবসা উন্নয়ন খাতে খরচ হলেও বেশির ভাগ অর্থের গন্তব্য নিয়ে এখনো বড় প্রশ্ন রয়েছে। অভিযোগ, বিটিআরসি এখন এসব দুর্নীতিবাজকে রক্ষায় উলটো আইওএফ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আইওএফ সভাপতি আসিফ সিরাজ রব্বানী দাবি করেন, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রথমেই এমডিএস (মার্কেট ডেভেলপমেন্ট এক্সপেন্সেস) ফান্ড বাতিল করেন। তার দাবি কারা কীভাবে অনিয়ম করেছে এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে বের করা হোক। আমরা নিয়ম মেনে ব্যবসা করতে চাই। ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজনের অনিয়মের দায় আমাদের কেন নিতে হবে?
আইওএফ-এর চিফ অপারেটিং অফিসার মুশফিক মনজুর জানান, প্রতিদিন এবং মাসিক ভিত্তিতে, আইজিডব্লিউ ও আইওএস অনুযায়ী ট্রাফিক রিপোর্ট এবং বিস্তারিত আর্থিক তথ্য ধারাবাহিকভাবে কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। আজ পর্যন্ত বিটিআরসির কোনো নির্দেশনা আইওএফ অগ্রাহ্য করেনি।
কল বিতরণে অসমতা নিয়ে বিটিআরসির অভিযোগ প্রসঙ্গে আইওএফ জানিয়েছে, প্রযুক্তিগত কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছিল। নভেম্বর ২০২৩ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত খাজা টাওয়ার পয়েন্ট অব ইন্টারকানেকশনে আগুন লাগার কারণে বড় ধরনের সার্ভিস ব্যাঘাত ঘটে। তবুও ১৩টি আইজিডব্লিউ ও ৬টি আইওএস সীমিত পরিসরে কাজ চালিয়ে যায়। এ সময় সমানভাবে কল বিতরণ প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব ছিল না এবং বিটিআরসিকে তা জানানো হয়েছিল। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের সময় সরকারি নির্দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয়ে গেলে সার্ভিস মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়।
বকেয়া পাওনা ও ব্যাংক গ্যারান্টির বিষয়ে আইওএফ জানিয়েছে, এখানে অভিযোগের কোনো সুযোগ নেই। কারণ সব আইজিডব্লিউ অপারেটরের পক্ষ থেকে বিটিআরসিতে ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান করা আছে, যা থেকে চাইলে যে কোনো সময় বিটিআরসি পাওনা রাজস্ব আদায় করে নিতে পারে।
২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সব আইজিডব্লিউ অপারেটর বিটিআরসিকে নিয়মিত পেমেন্ট করে আসছে। কেবল দুটি আইজিডব্লিউ অ্যাকাউন্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ফ্রিজ করে। ফলে তাদের সামান্য কিছু অর্থ বকেয়া পড়ে যায়। ওই অ্যাকাউন্টগুলোও বর্তমানে সচল। একটি অপারেটর ইতোমধ্যে পাওনা পরিশোধের জন্য আবেদন করলেও বিটিআরসির দিক থেকে এখনো কোনো সাড়া মেলেনি।
২০২৪ সালের ৩ ডিসেম্বর বিটিআরসি তিনটি আইজিডব্লিউর কার্যক্রম স্থগিত করে। অভিযোগ ছিল-বকেয়া পাওনা ও কল বিতরণে অসমতা। আইওএফ বলছে, এ সিদ্ধান্ত কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়াই এবং আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে নেওয়া হয়েছে।
চুক্তি পরিবর্তনের অভিযোগ প্রসঙ্গে আইওএফ-এর ব্যাখ্যা হচ্ছে- বিটিআরসির পূর্বানুমোদন ছাড়া কখনো কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। ২০২৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রেভিনিউ শেয়ারিং পার্টনার (আরএসপি) অনুপাতে সামান্য পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিটিআরসি অনুমোদন না করায় পরে তা আর কার্যকর হয়নি।
এছাড়া ৩ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে বিটিআরসি তিনটি ধারা পরিবর্তনের নির্দেশনা দেয়। আইওএফ একটি ধারা নির্দেশনা গ্রহণ করে। বাকি দুটির জন্য বিকল্প প্রস্তাব দেয়, যা ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ সালে অনুমোদনের জন্য জমা দেয়। ৭ ফেব্রুয়ারি একটি বৈঠকে আইওএফ প্রেসিডেন্ট কমিশনের সামনে ফোরামের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। সে বিষয়ে এখনো বিটিআরসি পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক জবাব আসেনি।
অবৈধ আন্তর্জাতিক কল বন্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ প্রসঙ্গে আইওএফ‘র ভাষ্য হচ্ছে-অবৈধ কল রোধ করা সরকারের ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অধীনে পড়ে। এখানে আইওএফ-এর বিশেষ কোনো দায় ও কর্তৃত্ব নেই। তবুও আমরা বিটিআরসির নির্দেশনা মেনে যখন যেখানে প্রয়োজন সর্বোচ্চ লজিস্টিক সহায়তা দিয়েছি। বিটিআরসি সদর দপ্তরে রিয়েল টাইম কল মনিটরিং সিস্টেম আমরা নিজের খরচে স্থাপন করে দিয়েছি।
এ প্রসঙ্গে বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল এমদাদ উল বারী যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয় নিয়ে তারা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবেন। এ নিয়ে কোনো আপত্তি থাকলে তা মীমাংসা করা হবে।
