Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রলোভন

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিএসবি গ্লোবালের প্রতারণা

বাশার ও স্ত্রী সন্তানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা * ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি

Icon

আসাদুল্লা লায়ন

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিএসবি গ্লোবালের প্রতারণা

স্বল্প খরচে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব টাকায় রাজধানীর গুলশান, বারিধারাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠানটি বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ গড়েছে। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ছয় শতাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণা করে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) অনুসন্ধান চালিয়ে বিএসবির অবৈধ কর্মযজ্ঞের প্রমাণ পেয়েছে। সম্প্রতি মানি লন্ডারিং আইনে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলাও করেছে সিআইডি।

সিআইডির অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদেশে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পরামর্শদানের (কনসালট্যান্সি) অনুমতি নিয়ে বিএসবি ২০০৩ সালে কার্যক্রম শুরু করে। এরপর থেকে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থী পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা নেয়। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না করে প্রতিষ্ঠানটি অর্থ আত্মসাৎ করে। এমন ১৪১ জন ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগ পেয়েছে সিআইডি। এর বাইরেও পাঁচ শতাধিক সেবাপ্রত্যাশী প্রতারিত হয়েছেন।

রোববার রাজধানীর গুলশান থানায় সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের এসআই রুহুল আমিন বাদী হয়ে বিএসবি গ্লোবালের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এতে প্রতিষ্ঠানটির মালিক খায়রুল বাশার বাহার, স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশন ও ছেলে আরশ ইবনে বাশার এবং অজ্ঞাতনামা চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের মালিক খায়রুল বাশার বাহারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন ও মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

মামলার বিবরণে বলা হয়, ঢাকার গুলশান সার্কেল-২ এলাকায় রব সুপার মার্কেটে ২০০৩ সাল থেকে বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থীদের পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিদেশি স্কুল ও কলেজে টিউশন ফি দেওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষার্থীদের নামে কোনো ফি জমা হয়নি। কয়েকজন ভুক্তভোগী ই-মেইলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ তথ্য জানতে পারেন।

ভুক্তভোগীরা অর্থ ফেরত চাইলে প্রতিষ্ঠানটি কখনো শিক্ষার্থী, কখনো প্রতিনিধি বা অভিভাবকের অনুকূলে ব্যাংক চেক দেয়। এসব চেকে টাকা না পেয়ে (বাউন্স হওয়ায়) কিছু ভুক্তভোগী মামলা করেন। গত বছরে বিভিন্ন সময় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একাধিক প্রতারণার মামলা হয়।

সিআইডি জানায়, ১৪১ জন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ১৮ কোটি ২৯ লাখের বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিএসবি গ্লোবাল। এসব টাকায় অভিযুক্তদের নামে ঢাকার গুলশান, বারিধারাসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থাবর সম্পদ কেনা হয়েছে। ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৫ ভুক্তভোগীকে নিয়ে আমির হোসেন মামলা করেন। ৩ কোটি ৯৫ লাখের বেশি অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ৩৫ জনকে নিয়ে রিতা আক্তার মামলা করেন। ১৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় জান্নাতুল ফেরদৌস মুক্তা মামলা করেন। এছাড়া ভুক্তভোগী তাওসিফ আলম আরাফের মা কানিজ ফাতেমা রুনা মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। সিআইডি জানায়, মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। এগুলো ছাড়াও তাদের নামে এনআই অ্যাক্টে মামলা চলছে এবং একাধিক ওয়ারেন্ট আছে।

বিএসবি গ্লোবালের প্রতারণার শিকার লিমা আক্তার জানান, তার মেয়ে ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে জানানো হয়, আমেরিকায় স্কুলিং ভিসার মাধ্যমে তার মেয়ে স্কলারশিপ পেয়েছে। মেয়ের সঙ্গে তিনিও আমেরিকায় যেতে পারবেন। কলেজ অফিসে যোগাযোগ করা হলে তাকে ক্যামব্রিয়ান স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান খায়রুল বশির পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বিএসবি গ্লোবালে পাঠানো হয়। সেখানে এক আমেরিকান নাগরিকের উপস্থিতিতে তথাকথিত ‘শুভেচ্ছা অনুষ্ঠানের’ আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের পর বিএসবি গ্লোবালের কর্মকর্তারা জানান, ভিসা প্রসেসিং ও মেয়ের এক বছরের সেশন ফি বাবদ ৬০ হাজার ডলার খরচ হবে। তবে ‘স্কলারশিপ’-এর আওতায় সবকিছু মিলিয়ে ১৫ লাখ টাকায় কাজ হবে। প্রাথমিকভাবে তিনি ৫ লাখ টাকা জমা দেন। লিমা বলেন, প্রথম কিস্তি জমা দেওয়ার পর আমার সঙ্গে বিএসবি গ্লোবাল নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। জানায়, আই-২০ তৈরি হয়ে গেছে। সবকিছু দ্রুত হয়ে যাবে। ঈদুল ফিতরের ঠিক দুদিন আগে আমাকে ফোন করে বলা হয়, আগামীকালের মধ্যে বাকি ১০ লাখ টাকা না দিলে এক বছরের জন্য পুরো প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাবে। বাধ্য হয়ে দুটি গরু বিক্রি করে এবং ধার করে বাকি টাকা দেওয়া হয়।

লিমা আক্তার জানান, পুরো টাকা জমা দেওয়ার পর ফাইল আটকে থাকার কথা বলা হয়। ফোন করা হলে তা রিসিভ করা হয় না। মাস তিনেক পর একদিন কল করে বলা হয়, ব্যাংক স্টেটমেন্ট তৈরি করতে হবে। আরও ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার পর তারা জানায়, অফার লেটার এসে গেছে। যে কোনোদিন হয়ে যাবে। এর মধ্যে আমি শুনতে পাই-আমার মতো শত শত মানুষ একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের বিজ্ঞাপন দেখে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেন আরেক ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মাহমুদুল করিম। তাকে জানানো হয়, কানাডায় যে টাকা খরচ হবে, সেই টাকা দিয়ে তিনি আমেরিকার ইনভেস্টর ভিসা পেতে পারেন। তাদের কথামতো ব্যবসার পুঁজি ভেঙে ও ফ্ল্যাট বিক্রি করে এক কোটি টাকা জমা দিই। তবে টাকা নেওয়ার পর থেকে তারা ফোন রিসিভ করেন না। মাঝেমধ্যে অফিসে গেলে বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করে। সম্প্রতি যোগাযোগ করা হলে এক কর্মকর্তা জানান, তার কোনো কাজই হয়নি। পুরো টাকা কোম্পানি নিজের কাছে রেখে দিয়েছে।


প্রতারণা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম