বাজেটে ৪ লাখ গরিবের কর্মসংস্থানে রূপরেখা
শঙ্কা তালিকা প্রণয়নে
একশ টাকা বাড়িয়ে মজুরি ৫শ টাকা, বরাদ্দ ১৬৫১ কোটি টাকা * এ কর্মসূচি আরও শক্তিশালী করা দরকার -ড. জাহিদ হোসেন
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলায় আগামী (২০২৫-২৬) অর্থবছরের বাজেটে চার লাখ অতিগরিব মানুষের কর্মসংস্থানের রূপরেখা থাকছে। এই কর্মসূচির নাম ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান’। যাদের দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা। যদিও দেশে অতিদরিদ্র লোকের সংখ্যা বেসরকারি হিসাবে চার কোটিরও বেশি, সরকারি হিসাবে ৯৫ লাখ। তবে শঙ্কা হচ্ছে এই কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীদের স্বচ্ছ তালিকা প্রণয়নে। এর আগে এ কর্মসূচি ঘিরে বিভিন্ন জেলায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে সংশ্লিষ্ট একাধিক অফিসে হানা দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। গরিব মানুষের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ থাকছে এক হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে এমন তথ্য দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, মেগা প্রকল্প নেওয়া হবে না, তবে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রকল্প নেওয়া হবে। গুরুত্ব দেওয়া হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিনিয়োগকে।
অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচি বিগত কয়েক বছর ধরে পরিচালনা হয়ে আসছে। পাশাপাশি এ কর্মসূচি ঘিরে নানা দুর্নীতি অনিয়মও হয়েছে। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম ফটিকছড়িতে এই কর্মসূচির সাড়ে ছয় লাখ টাকা মজুরি আত্মসাতের কারণে ইউপি চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে। এছাড়া শরীয়তপুর সদর উপজেলার আংগারিয়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থানের তালিকায় নিজের স্ত্রী, সন্তান, পুত্রবধূ, ভাইসহ ১১ জন স্বজনের নাম দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেন। গত বছর চটগ্রাম লোহাগাড়া উপজেলার চরম্বা ইউনিয়নে ভুয়া শ্রমিক দিয়ে মোবাইল ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা তুলে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান। ২০২১ সালে দেশের ২০ এর অধিক জেলায় কর্মসৃজন প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ পায় দুদক। এরপর ২১ জেলায় একযোগে দুদক অভিযান পরিচালনা করে এই কর্মসূচি ঘিরে। সেখানে দেখতে পায় ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে মজুরি উত্তোলন, কাজ না করে এবং উপকারভোগীর স্বাক্ষর গরমিলের মাধ্যমে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, এই কর্মসূচি ঘিরে বিগত সময়ে আসা অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে আগামীতে যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এ কর্মসূচি বন্ধ করা যাবে না। কারণ শতভাগ সুবিধা যে কারও কাছে যাচ্ছে না তাও নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সেগুলো বিবেচনায় আনলে এ কর্মসূচি আরও শক্তিশালী করা দরকার। এজন্য দরকার বাস্তবায়নে দক্ষতা বাড়ানো।
সাধারণত গ্রামের অতিদরিদ্র মানুষ অন্য কোথাও কাজ না পেলে অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতাভুক্ত হয় সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন কাউন্সিলে নাম নিবন্ধনের মাধ্যমে। এই কর্মসূচির আওতায় নির্ধারিত দৈনিক মজুরি বাজারে বিদ্যমান শ্রমিকের মজুরির চেয়ে কম। সংশ্লিষ্টদের মতে, এর কারণ যেকোনো খাতে স্বাভাবিক কাজ পেলে সেটি বাদ দিয়ে এখানে যেন যোগদান করতে উৎসাহিত না হয়। এই কর্মসূচিতে যুক্ত হতে পারবেন যারা কর্মহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, যার কাজের সামর্থ্য আছে এবং ভূমিহীন (বাড়ি ছাড়া ০.৫ একরের কম পরিমাণ জমি আছে)। যার মাসিক আয় চার হাজার টাকার কম অথবা যার মাছচাষের জন্য পুকুর বা কোনো প্রাণিসম্পদ নেই।
সূত্র মতে, চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে এ কর্মসূচির আওতায় একজন শ্রমিককে দৈনিক মজুরি দেওয়া হয় চারশ টাকা। সেখান থেকে একশ টাকা বাড়িয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য মজুরি পাঁচশ টাকা ধরা হয়েছে।
যে কারণে প্রাধান্য পাচ্ছে এ কর্মসূচি : সূত্র মতে, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমিক বিক্ষোভের ফলে পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়ছে। ইতোমধ্যে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সেখানে কর্মরত শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ছেন। এছাড়া নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে কর্মসংস্থানও নতুন সৃষ্টি হচ্ছে না। উভয় সঙ্কটের চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। অপর দিকে, টানা মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। নতুন করে অতিদরিদ্র হয়ে পড়েছে ৩৭ লাখ মানুষ এমন তথ্য দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরে শ্রমবাজারের দুর্বল অবস্থা অব্যাহত থাকবে। শুধু অতি দারিদ্র্য হার নয়, জাতীয় দারিদ্র্য হারও বাড়বে। সেখানে আরও বলা হয়, অতি দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে উঠবে। জাতীয় দারিদ্র্য হার গত বছর ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালে তা বেড়ে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। গরিব মানুষের চাপ বাড়লেও কর্মসংস্থান সেভাবে বাড়ছে না। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার এই কর্মসূচিকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে জানা গেছে।

